মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যে রাজনীতি চেতনা
মহাশ্বেতা দেবী প্রতিদিনের বিপ্লবী। শ্রেণি সংগ্রাম তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ভদ্রলোকদের চোখের অন্ধকারে মিশে থাকা অযুত আরণ্যক মানুষের প্রাণ থেকে প্রান্তরে। আজীবন সংগ্রামী চিন্তা চর্চা করেছেন এবং দেশ ও মানুষ সব ধরনের শোষণমুক্ত হবে সেই লক্ষ্যে সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি সরাসরি সে আদর্শ লালন করতেন, যে আদর্শের ছবি পাওয়া যায় তার সাহিত্য ও জীবনচর্চায়।
পারিবারিকভাবেই তিনি সাহিত্যবেষ্টিত পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে দুটি কবিতা উপহার দিয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবীর রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আগে তার পারিবারিক পরিমণ্ডল দেখে নেওয়া জরুরি। তাঁর বাবা মনীশ ঘটক বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন। ছোট কাকা ঋত্বিক ঘটক ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক ব্যতিক্রমী প্রতিভার শ্রদ্ধেয়জন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। একসময় পার্টিতে তিনি ভিন্ন দলিল স্থাপন করে পার্টির সদস্যপদ হারালেও তাতে দমে যাননি। তারপরও তিনি কমিউনিস্ট হিসেবে নিজেকে দাবি করতেন না, বলতেন, ‘কমিউনিস্ট চিন্তা একটি চর্চা। প্রতিনিয়ত তাঁকে আপডেট করতে হয়। কমিউনিস্ট হতে কোনো পার্টির ফরম ফিলাপ করতে হয় না। তাঁর কাজ-কর্মই সে সাক্ষ্য দেবে।’
১৯৪৩-এ মন্বন্তরের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মহাশ্বেতা দেবীকে প্রথম আবিষ্কার করা যায় একজন রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে। অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে। তিনি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তখন তিনি এই দলের ছাত্রী সংগঠন ‘Girls Student Association’-এ যোগ দেন এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় ত্রাণকাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মিটিংয়ে যোগ দিতেন, পার্টির মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’ বিক্রি করতেন এবং সে পত্রিকার নিয়মিত পাঠকও ছিলেন। পার্টির সদস্যপদ পাওয়া সহজ ছিল না। তবে সদস্য না হয়েও কাজ করা যেত। সেভাবেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলত তখন থেকেই তাঁর কর্মিসত্তার বিকাশ, যা পরবর্তীকালে আরো বিকশিত হয়।
১৯৪৪ সালে মহাশ্বেতা ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে, বিএ পড়তে। ১৯৪৬ সালে আবার কলকাতায় ফিরে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পড়াশোনা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট নাট্যকার এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের সংসার-জীবন ছিল দারিদ্র্য পরিবেষ্টিত, এ সময় মহাশ্বেতা দেবী রং-সাবান, রঙের গুঁড়া ফেরি করেন, ছাত্রও পড়াতেন। এই জীবনযুদ্ধ তিনি শেষ দিন পর্যন্ত করেছেন।
১৯৬৪ সালে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা পেশায় যোগ দেন বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে। এরই মধ্যে তাঁর প্রথম বই ‘ঝাঁসীর রানী’ (১৯৫৬) প্রকাশিত হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে তিনি লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতিহাস তাঁর সাহিত্যজীবনে সব সময়ই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের মুখ্য কাজই হচ্ছে একই সঙ্গে বাইরের গোলমাল, সংগ্রাম ও সমারোহের আবর্জনা এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জনবৃত্তকে অন্বেষণ করা, অর্থ ও তাৎপর্য দেওয়া। এর মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে সমাজনীতি ও অর্থনীতি, যার মানে হলো লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লৌকিক জীবনব্যবস্থা। তাঁর প্রথমদিকের সাহিত্যকর্মে এই প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় খুদাবক্স ও মোতির প্রেম কাহিনি নিয়ে ১৯৫৬ সালে ‘নটী’ উপন্যাসটি লেখেন। এ ছাড়া প্রথম পর্যায়ে তিনি লোকায়ত নৃত্য-সংগীতশিল্পীদের নিয়ে লিখেছেন ‘মধুরে মধুর’ (১৯৫৮), সার্কাসের শিল্পীদের বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে লেখেন ‘প্রেমতারা’ (১৯৫৯)। এ ছাড়া ‘যমুনা কী তীর’ (১৯৫৮), ‘তিমির লগন’ (১৯৫৯), ‘বায়োস্কোপের বাক্স’ (১৯৬৪) প্রভৃতি উপন্যাস।
মহাশ্বেতা দেবী নিজের লেখা সম্পর্কে নিজেই সমালোচক হয়ে উঠেছেন কখনো কখনো, ইতিহাস চর্চা আর সমাজ-সচেতনতায় দৃঢ় হয়ে ওঠেন বলেই যেন তাঁর প্রথম পর্বের দুটো উপন্যাস ‘তিমির লগন’ ও ‘রূপরেখা’য় ব্যক্তির সুখ-দুঃখ যখন কোনো সামাজিক তাৎপর্য বহন করে না বলে মনে করেছেন, তখন তিনি এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন- ওই বই দুটো আর ছাপবেন না। আবার অন্যদিকে গভীর সামাজিক তাৎপর্য থাকার জন্য, প্রথম প্রকাশের কুড়ি বছর পরও ‘বিষয়বস্তুর চিরকালীনতা ও প্রয়োজনীয়তা আজও’ রয়েছে বলে মহাশ্বেতা দেবী মনে করেন, ‘মধুরে মধুর’ আজকের পাঠকের কাছে বইটি থাকা দরকার।
দুই
নিঃসঙ্গ জীবন, বিচ্ছেদ-বিরহ-বেদনায় তিনি নিজেকে সঁপে দেন লেখা এবং শিক্ষার ব্রতে। তাঁর পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে সাহিত্যকর্মেও যে পরিবর্তন এসেছিল, এ-প্রসঙ্গে জীবন ও দর্শন নিয়ে কল্যাণ মৈত্রের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, ‘‘... ‘হাজার চুরাশির মা’ লিখেছিলাম ওই সময়ে। উপন্যাসটা পড়লে বোঝা যাবে। আর ওই সময় আমি অসম্ভব ঘুরে বেড়াতে লাগলাম- তার একমাত্র কারণ ছিল এটাই। মনের একটা কষ্টকে চাপতে চেষ্টা করছি। হয়তো এটাই আমার জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট। ওই সময় দিনে চৌদ্দ-পনেরো ঘণ্টা কাজ করেছি।... এদিকে আমি কোয়ালিটি রাইটিংয়ের দিকে মন দিলাম, অন্যদিকে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ শুরু করলাম। এই দিকটা অবশ্যই আমার লেখা সমৃদ্ধ করতে শুরু করেছিল। একটা না দেখা ওয়ার্ল্ড, কেউ জানে না, বোঝে না। তার সমস্ত অনুভূতিগুলি, ক্ষোভ-দুঃখ আমার লেখার সঙ্গে খুব মিশে যাচ্ছিল।”
কমিউনিস্ট লেখক হিসেবে তাঁর লেখাগুলো হয়ে উঠেছে শোষক ও শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মুক্তির ইশতেহার। ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে ঢাকায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে আলাপে তিনি উচ্চারণ করেনে, ‘আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। বইটি লিখে আমি টাকা পেয়েছিলাম। সেই থেকে আমি প্রফেশনাল লেখাতে বিশ্বাসী। লেখা আমার প্রফেশন, আমার আর কোনো জীবিকা নেই। মাঝখানে কয়েক বছর কলেজে পড়িয়েছিলাম, সতেরোশো টাকা মাইনে হতো, মনে হলো যে মহাপাপ করেছি, তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিলাম। আমি যেন নিজের গুরুত্ব ভুলে যাচ্ছি। আসলে লেখাই আমার জীবিকা ছিল।’
এরপর তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে যে উপন্যাসগুলো লেখেন, এগুলোর মধ্যে ‘আঁধার মানিক’ (১৯৬৬), ‘হাজার চুরাশির মা’ (১৯৭৪) উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে তিনি রাজনৈতিক চেতনার ও ইতিহাস-আশ্রিত কাহিনি যেমন লিখেছেন, তেমনি আদিবাসীকেন্দ্রিক উপন্যাসের সূচনাও ঘটে এ সময়। ‘হাজার চুরাশির মা’ এ সময়ে লেখা তাঁর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস হলেও ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু’ উপন্যাসটি একটি ব্যতিক্রমী উপন্যাস এবং আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসের শুরুও- এটা বলা যায়। লেখার উপজীব্য হিসেবে তিনি অধিকার হীন আরণ্যক সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বেছে নিয়েছিলেন। তাদের জীবন-সংস্কৃতি-সংগ্রাম না বলা অনেক কথা নিয়ে যে কথাসাহিত্যের বুনিয়াদ তিনি সৃষ্টি করেছেন তা অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তবে তিনি যে লেখার মধ্য দিয়ে অরণ্যের মানুষকে অধিকারসচেতন করেছেন- জঙ্গল মহল, ছত্তিশগড়ে যদি তাঁর এতটুকু হাওয়া লেগে থাকে তাহলে বলতে হবে, এখানে হয়তো ঝড় উঠবেই; যার পথ তিনি তৈরি করে গেছেন।
‘হাজার চুরাশির মা’ তাঁর সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনের সূচনা বলে মনে করা হয়। এ-সময় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-সাহিত্য ও দর্শনের নতুন সত্তার প্রকাশ ঘটে। ‘ঘরে ফেরা’ (১৯৭৯) উপন্যাসেও রাজনৈতিক অন্তর্বিশ্লেষণের ভিন্ন প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ সময় তিনি ছোটগল্পেও এই ভাবধারার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মহাশ্বেতা দেবী অন্ত্যজ আদিবাসীদের চোখ দিয়ে জীবন ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের পুরাণকথার ভেতর দিয়ে ইতিহাস তুলে এনেছেন, যা ছিল আধিপত্য বিস্তারকারী হেজিমনি শ্রেণির নয়, বরং শোষিত দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। প্রান্তিক কণ্ঠস্বর তুলে এনেছেন মূলস্রোতের মানুষের সাহিত্যে, যা নিচের দিক থেকে ইতিহাসকে দেখবার ইঙ্গিত বহন করে, ওপরের দিক থেকে নয়। যা সাব-অলটার্ন স্টাডিজের অংশ হয়ে দেখা দেয়। মার্কসবাদে সাব-অলটার্ন শব্দটির ব্যবহার পুরোনো। অ্যান্তোনিও গ্রামশি (১৮৯১-১৯৩৭) তাঁর বিখ্যাত ‘কারাগারের নোটবুক’ বইটিতে এ-সম্পর্কিত আলোচনার অবতারণা করেন। গ্রামশির মতে, কৃষকদের পক্ষে কলম ধরতে হবে বুদ্ধিজীবীদের। মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক, ভৌগোলিক পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিবর্তনের ধারায় সে-দেশীয় আদিবাসী জীবনের পরিবর্তন বর্ণনা করেন। পাহাড়ি অরণ্য জীবনের সঙ্গে ফুটে ওঠে পরিবেশের বিপন্নতার চিত্র, যা আজকের পৃথিবীকেও বিচলিত করে, সেই আখ্যান সাহিত্যে রূপ দিয়ে আদিবাসী জীবনে ঘটে যাওয়া উলগুলান (১৯০০), কোলহান (১৮৩৫) এবং হুলকে (১৮৫৫-৫৬) নিয়ে আসেন।
আদিবাসীদের নিয়ে বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন তিনি। এসব গল্প-উপন্যাসে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে যেমন আদিবাসী প্রতিবাদী চরিত্র চিত্রিত করেছেন, তেমনি এদেশীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শোষণের প্রতিবাদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরে তুলে ধরেছেন। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ফরম পূরণ না করে তিনি ছোট কাকা ঋত্বিক ঘটকের পথেই হেঁটেছেন।
তথ্যঋণ
অন দ্য কালচারাল ফ্রন্টিয়ার্স : ঋত্বিক ঘটক
মার্কসিস্ট লিটারেচার : টেরি ঈগলটন
প্রান্তিকের কণ্ঠস্বর : মহাশ্বেতা দেবী : বদরুন নাহার