বাংলাদেশের সাহিত্য বিশ্বমানের : সেলিনা হোসেন
‘লেখক যখন একটি মাত্রা পায় তার শৈশব থেকে, শৈশবের আগেও জন্মের পর থেকে, যেখানে তার অনুভব কাজ করে না, চিন্তার জগৎও থাকে না- সেই জায়গা থেকে আমি আমাকে চিন্তা করি, তখনই যখন আমি নিজের দিকে তাকাই। এক অসাধারণ শৈশব ছিল আমার। আমার শৈশবের মধ্যে দুটো জিনিস দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, একটি প্রকৃতি আর অন্যটি ছিল মানুষ। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক, প্রকৃতিকে নিজে স্থাপন করে নেওয়ার মধ্যে নিজেকে বুঝে ওঠার সম্পর্ক। এ রকম সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতা বিচিত্র প্রভাব রেখেছে আমার লেখাজোকায়, আর এসব সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন গল্প লিখেছি আমি।’- এমন করেই নিজের লেখালেখি সম্পর্কে মন্তব্য করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। গত ১৪ জুন, তিনি ৬৯ বছরে পা দিলেন। এই অতিক্রান্ত আটষট্টি বছরের মধ্যে ৫১ বছর তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর লেখার সংখ্যা অনেক। বিষয় বৈচিত্র্যেও তা অনন্য। মূলত বাংলা সাহিত্যে এখন অবধি যে কজন লেখক বিপুল ঋদ্ধিতে টিকে আছেন, তাঁদের মধ্য সেলিনা হোসেন একজন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, হাজার বছরের লেখালেখির ইতিহাসে নারী লেখকের আগমন খুব বেশি দিনের নয়। তা ছাড়া বিভিন্ন প্রতিকূলতা তাঁদের অতিক্রম করতে হয় শুধু ‘নারী লেখক’ বলেই। যে কারণে তার সংখ্যাও অত্যন্ত কম। এমনকি এই আধুনিক সমাজেও তাঁদের উপেক্ষার মাত্রা কম নয়। অনেক নারী লেখকের লেখাতে আবার ‘নারীবাদী’ ফেনমেনা দ্বারা আক্রান্ত। সেলিনা হোসেনকে আমরা কোনো ভাবেই তাঁদের দলে ফেলতে পারি না। পারি না তাঁর লেখনির কারণে। তিনি অনেক আগেই লেখনির বিষয়বস্তু, বিপুল সৃষ্টি ও শক্তি দিয়েই তাঁর সাহিত্যিক স্থান পাকাপাকি করে নিয়েছেন। তিনি কথা সাহিত্যিক, লেখক ও ঔপন্যাসিক।
প্রকৃতি সেলিনা হোসেনের লেখনিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে প্রকৃতি। তাঁর মতে-‘প্রকৃতি আমার কাছে প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। আমি মনে করি নিজের বেঁচে থাকার মধ্যে প্রকৃতির সাথে অদ্ভূত যোগ আছে। সেই যোগ থেকে কখনো কখনো আমি প্রকৃতিকে আমার উপন্যাসে, গল্পে চরিত্র হিসেবে দেখি। সবকিছুর ভিতর থেকে প্রকৃতির যে একটা অসাধারণ অপূর্ব চিত্র ফুটে ওঠে। এটা আমি শৈশব থেকে দেখে এসেছি, এখনো সে দেখাটা আমার শেষ হয়নি এবং শেষ হবে না কোনো দিনই। যত দিন আমি লিখতে পারব লেখার চরিত্রের মধ্যে এই প্রকৃতি আরেকটি চরিত্র হয়ে ফুটে ওঠবে।’
সেলিনা হোসেন লিখতে শুরু করেছিলেন গণমানুষের কথা বলার উদ্দেশে, যারা নিজেদের বঞ্চনার কথা নিজেরা বলতে পারে না। সংগ্রামী আলেখ্য তাঁর উপন্যাসের মৌলিক উপাদান। তাঁর সৃষ্ট বেশির ভাগ চরিত্র সংগ্রামী ও সংবেদনশীল। ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও আন্দোলন তাঁর ঔপন্যাসিক সত্তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে। তার উপন্যাসে রয়েছে একদিকে শ্রেণি সংগ্রামের উদ্দীপনা অন্যদিকে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন। আর এ জন্য আমরা বলতে পারি, এ সব বিষয়ের একটা সূত্র সেলিনা হোসেনের জন্ম ও লেখক হিসেবে বেড়ে ওঠার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন। জন্মের সময়ের দিকে তাকালে উপলব্ধি করা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন অত্যুঙ্গ পর্যায়ে। তাঁর জন্মের ঠিক তিন মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট পৃথিবীতে প্রথম আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অনেক দেশেই তখন হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভারত বর্ষেও এই যুদ্ধের প্রভাব এসে পড়েছিল। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ইতিহাসে ‘পঞ্চাশের মন্বতর’ হিসেবে যা পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের তুলনায় ২০ গুণ বেশি মানুষ মারা যায়। এই ভয়াবহতার রেশ সেলিনা হোসেন জন্মমাত্রই লাভ করেন। সবচেয়ে বড় যে বিষয়, তার জন্মের অল্প দিনের মধ্যেই ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত হয় এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা ঘটে তার জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই। আরো একটি দিক হলো, তাঁর জন্মস্থান, রাজশাহীতে তখন তেভাগা আন্দোলনের জন্য উত্তাল। একজন ভবিষ্যৎ সংবেদনশীল লেখক হিসেবে সেলিনা হোসেন যে এসব ঘটনার আঁচ গায়ে মেখে বেড়ে উঠবেন তা অবশ্যাম্ভাবি ছিল তাই নয় কি?
সেলিনা হোসেনের লেখালেখি শুরু সেই স্কুলবেলাতেই। ১৯৬৫ সালে তিনি যখন রাজশাহী উইমেন্স কলেজের ছাত্রী তখন বিভাগীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পান। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে বিএ (অনার্স) ও ১৯৬৮ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চায় নিবিড়ভাবে যুক্ত হন। সে সময় তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে তিনি সমাজ দর্শন হিসেবে সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করার প্রযোজন বোধ করি যে, সে সময় এই রাজনৈতিক আদর্শ ও সমাজ দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও পরবর্তী সময়ে অনেকেই বদলে যায় কিন্তু তিনি তা পরিহার করেননি। বরং লেখনির মাধ্যমে তার বিস্তার ও দিক অন্বেষণ করেছেন।
প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯৬৭ সালে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পাঞ্জাব যাওয়ার কথা থাকলেও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার কারণে যাননি। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৫ এবং ১৯৬৯ সময়পর্ব তিনি অতিক্রম করেছেন এবং শিক্ষার্থী জীবনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী শামসুজ্জোহা পাকিস্তানিদের হাতে খুন হন। সুতরাং এই সব সময়পর্ব ও ঐতিহাসিক ঘটনা মনে রাখলে উল্লেখ করা যায়, সেলিনা হোসেনের কোনো সুযোগই ছিল না, ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হওয়ার। বরং বলতে দ্বিধা নেই যে, সেলিনা হোসেন তাঁর প্রজ্ঞা ও মননের মাধ্যমে তাঁর সময় ও ইতিহাসের প্রতি যথার্থই সাড়া দিয়েছেন।
প্রথম জীবনে সেলিনা হোসেন কবিতা দিয়েই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন। মধ্য সত্তরের দশকে তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। অর্থাৎ স্বাধীনতাপূর্ব এক বন্ধ্যা ও নিয়ন্ত্রিত সময়ে একজন নারী সাহিত্য মাধ্যমে সক্রিয় থাকছেন, তাঁর গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করছেন- এটা সত্যিই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই বছর প্রবন্ধের জন্য তিনি ডক্টর এনামুল হক স্বর্ণপদক পান।
সেলিনা হোসেনের প্রথম গল্পগ্রন্থের নামে যে দ্যোতনা পরিলক্ষিত হয়, তা পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখায় প্রমাণ মেলে। তিনি এখনো বাঙালির যে উৎস তা নানাভাবে উন্মোচন করে চলেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে যে বিপুল ও সমৃদ্ধ লেখনি উপহার দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছে অহর্নিশ। ইতিমধ্যে ৩১টি উপন্যাস, ১১টি গল্পগ্রন্থ এবং ৯টি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর ৩০টি শিশুতোষ গ্রন্থ রয়েছে। তিনি নারী অধিকার বিষয়ক বেশ কিছু প্রামাণিক গ্রন্থও রচনা করেছেন- যেগুলোতে তাঁর সমাজ মনস্কতা ও বৈচিত্র্যকেই নির্দেশ করে।
লেখালেখির দর্শনের ব্যাপারে সেলিনা হোসেন বরাবরই স্বচ্ছ। অপর একটি সাক্ষাৎকারে সেলিনা হোসেন বলেন, ‘তখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। ভেবেছিলাম এই রাজনীতি মানুষকে ভাত, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা দেবে। মানুষের জীবন হবে স্বস্তি ও শান্তির। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষের পরই রাজনীতির পাঠ শেষ করে দেই, লেখালেখির জগৎ ধরে রাখব বলে। রাজনীতির যে আদর্শগত দিক শিক্ষাজীবনে গ্রহণ করেছিলাম তার প্রয়োগ ঘটিয়েছি লেখাতে। তবে সরাসরি নয়। সৃষ্টি কাহিনী, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। মানবিক মূল্যবোধের জায়গা সমুন্নত রেখে। বেঁচে থাকার মাত্রার সমতার বিন্যাস ঘটিয়ে। মানুষের ভালোমন্দের বোধ রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জায়গায় রেখে আমি রাজনীতির নানাদিকের প্রতিফলন ঘটাতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা জনসাধারণের জীবন রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে মানুষ– এটাই আমার গভীর বিশ্বাস।’
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’। উপন্যাসটিতে সেলিনা হোসেনের শৈশবে প্রকৃতি, বঙ্গোপসাগর এবং অসংখ্য নদী-নালা দেখে চিত্রকল্প খুঁজে পেতে প্রয়াসী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও রাজনীতির সক্রিয় অংশগ্রহণের সময় কাটে স্বৈরশাসকের যাতাকলে প্রতিবাদ করে। স্বাধীনতার পরও স্বৈরশাসন ফিরে এসেছে। তিনি কখনোই স্বৈরশাসন মেনে নিতে পারেননি। আর তাই তাঁর ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে সামরিক শাসনের প্রসঙ্গ পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিক সময় ছিটমহল প্রসঙ্গটি নানাভাবেই আমাদের দেশে আলোচিত। লেখিকা নিজে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা এবং পঞ্চগড় এলাকার অনেক ছিটমহল ঘুরে দেখেছেন তাঁর ভ্রমণের নেশা থেকে। সেখানকার জীবনের সংকট ও নিয়ন্ত্রিত জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেন উপন্যাস ‘ভূমি ও কুসুম’।
সেলিনা হোসেন জীবনে বিরূপ অভিজ্ঞতাকেও নান্দনিক উপন্যাসে রূপান্তর করেছেন। এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তাঁর প্রিয় কন্যা ফারিহা লারা। তাঁর স্মৃতি ও লেখকের যন্ত্রণা থেকে লিখেছেন উপন্যাস ‘লারা’। উপন্যাসটি তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিজাত হলেও তাতে মা-মেয়ের সম্পর্কের চিরন্তন বিষয়টিই মুখ্য হয়ে প্রতীয়মান হয়েছে। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সেলিনা হোসেনের একমাত্র উপন্যাস ত্রয়ী। ১৯৯৪ সাল থেকে যথাক্রমে পরপর এর খণ্ডগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। উপন্যাসটির জন্য তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘যাপিত জীবন।’ পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভুক্ত উপন্যাসের এটি একটি। এ ছাড়াও শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত হয়েছে। তবে তাঁর পাঠকপ্রিয় উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। সেলিনা হোসেনের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, উপন্যাসটি নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু এবং ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তন ও তাঁর নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণে তা আর করা হয়নি। ১৯৮৭ সালে বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। প্যারিসের ‘দ্য গল’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান লিটারেচারের অধ্যাপক পাস্কেল জিন্ক নেট থেকে বইটির ইংরেজি সংস্করণ সংগ্রহ করে অধুনিক অনুবাদের উদ্যোগ নেন। যা পরে ভারতের রূপা প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া শিকাগোর ওকটন কমিউনিটি কলেজে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ চারটি সেমিস্টারে পড়ানো হয়। ২০০১ সালে উপন্যাসটি ভারতের কেরালা থেকে মালয়ালাম ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই সেলিনা হোসেন বিভিন্ন পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখতেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের জন্মদিনে তিনি এ পদ থেকে অবসর নেন। ৩৪ বছরের কর্ম সময়ে তিনি বাংলা একাডেমির অভিধান ও বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলি প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করেন। এ ছাড়া তিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।
বাংলা একাডেমিতে গবেষণার সুবাদে ইতিহাসের বহু মানুষ সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। যা তাঁর সাহিত্যিক জীবনে কাজে লেগেছে। তিনি বিভিন্ন সময় ঐতিহাসিক বিষয়ের সমকালীন প্যারালালধর্মী উপন্যাস লিখেছেন। যা তাঁর ভাষায় ‘ঐতিহ্যের নবায়ন’। তিনি মোগল আমলের বিখ্যাত কবি মির্জা গালিবের জীবনী নিয়ে লিখেছেন ‘যমুনা নদীর মুশায়েরা’। এতে গালিবের জীবনের এক ধরনের ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রীতিলতাকে নিয়ে লিখেছেন ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’। ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসে দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের মানুষের জীবনের খুবই বাস্তব এবং জটিল একটি চিত্র তুলে ধরেছেন সেলিনা হোসেন। শোষিত শ্রেণির উত্থানের সময় শাসক শ্রেণির মধ্যে যে হিংসা, আতঙ্ক দেখা দেয় এবং এ থেকে উদ্ভূত ক্রোধ তাদের নিকৃষ্ট কাজ করতেও বাধা দেয় না- এই ব্যাপারটি তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ, রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাথে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছু পরিবারের চিত্র নিয়ে লিখেছেন ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’।
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে অনুপ্রেরণার অন্যতম জায়গা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘পূর্ণছবির মগ্নতা’ উপন্যাসে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনেকটা এ দেশীয় ভাবে নির্মাণ করেন। এটা করতে গিয়ে তিনি আখ্যানের ভেতরে ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পের রতন, ‘শাস্তি’র চন্দনা, ‘ছুটি’ গল্পের ফটিককে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে লেখিকা বলেন, ‘আমার সব সময়ই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ এ ভূখণ্ডে না এলে, যাদের আমরা সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ বলি, কবির অদেখায় থেকে যেত এই জনগোষ্ঠী। তাতে হয়তো তাঁর জীবনদর্শনও অপূর্ণ থাকত খানিকটা। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, আমাদের এই বাংলাই ভিন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে রবিঠাকুরকে।’
গল্পের ক্ষেত্রেও সেলিনা হোসেন সাফল্য ও প্রাচুর্যের প্রমাণ রেখেছেন সমানভাবে। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘জলবতী মেঘের বাতাস’। নানা কারণেই এটি বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সব লেখাই পত্রগল্প। এতে তিনি সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, হাসান আজিজুল হক, বদরুদ্দীন উমর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবীর চৌধুরীসহ ১০ জনকে সম্বোধন করে পত্র ভাষায় গল্প লিখেছেন।
সাহিত্যে সমাজ নিষ্ঠা থেকেই সেলিনা হোসেন নারীর ক্ষমতায়নে সচেষ্ট। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তিনি নারীর ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ বলে মনে করেন। এ জন্য ‘লারা ফাউন্ডেশন’ নামক একটি সামাজিক উন্নয়ন সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তিনি। আশির দশকের প্রথম থেকেই সেলিনা হোসেন বহির্বিশ্বে আমাদের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), একুশে পদক (২০০৯)। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা থেকে ডিলিট উপাধি (১৯১০), রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা (২০১৩) ইত্যাদি।
সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসের কাহিনীর অভিনবত্ব, জীবননিষ্ঠা, দৃশ্যকল্প, বিস্তৃত বয়ান ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য সেগুলোকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণে বাধিত করেছে। তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস-গল্প চলচ্চিত্র ও নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি।
অনেক ক্ষেত্রে বাংলাসাহিত্যের অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যের সঙ্গে এখানো তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। সাহিত্য সৃষ্টি ও স্বীকৃতির পর তিনি নিজেকে রাখেন নৈর্ব্যক্তিকের ভূমিকায়। সময়কেই তিনি সাহিত্যের বড় সমালোচক মনে করেন। তাঁর ভাষায়, ‘মানসম্মত রচনার মূল্যায়ন করবেন সমালোচক। সবার উপরে বড় সমালোচক সময়। কালের বিচার বড় নির্মম। কাউকে ক্ষমা করে না। যা বাতিল হওয়ার যোগ্য তা স্বাভাবিক নিয়মে বাতিল হবে। বাংলাদেশের সাহিত্য মানের দিক থেকে বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয়।’
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের অনন্য দিক হলো ইতিহাসে মানুষের প্রভাব ও অংশগ্রহণ। আর তাই তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত সাহিত্যের পরিমাণ অনেক। তা ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর সাহিত্যের চরিত্ররা নানাভাবে পীড়িত হলেও উন্মুল হয় না কখনো। তাঁর উপন্যাসে, গল্পে চরিত্র হিসেবে দেখা যায় প্রকৃতিকে। সবকিছু মিলে বলা যায় সেলিনা হোসেন।
উৎস থেকে উৎসারিত, সতত বহমান- এই সব জীবন চরিত্র যেন নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনির মতোই তাদের সংগ্রামের চিত্র রচনা করে চলেছেন আর তা অনেক অনেক দিন বিচিত্র দ্যোতনায় অনুরণিত হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।