ভুল বানানে ভরা ‘কারাগারের রোজনামচা’
খুব আগ্রহ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি সংগ্রহ করি। যার মাধ্যমে সংগ্রহ করি তাঁকে বলেছিলাম একাধিক কপি কিনে আনার জন্য। ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বইটি কাছের কয়েকজনকে উপহার দেওয়ার জন্যই সেটা বলেছিলাম। কিন্তু, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নিষেধ থাকায় একাধিক বই কেনা সম্ভব হয়নি। এর কারণ কী তা আমাদের বোধগম্য নয়। যে সময়ে মানুষ বই পড়তে চায় না, সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর বই কিনে উপহার দিয়ে পাঠে আগ্রহী করতে বাধা পাওয়ায় মর্মাহত হয়েছি। যাক, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই গ্রন্থটি থেকে পাঠক অনেক কিছুই জানতে পারবে। কারাগারের ভেতরের অনেক অজানা বিষয় কত চমৎকারভাবে যে লেখা যায় তা গ্রন্থটি পাঠ না করলে বোঝা যাবে না।
কিন্তু, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থে বঙ্গমাতার নামের বানানসহ নানা ভুল বানানে যদি ভরপুর থাকে তাহলে এর দায় কে বহন করবে? ২৯৮ পৃষ্ঠার দুটি ছবির ক্যাপশনে বঙ্গমাতার নাম ছাপা হয়েছে ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা’। অথচ গ্রন্থটিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার যে ভূমিকা রয়েছে সেখানে ছাপা হয়েছে ‘ফজিলাতুননেছা’। আমরা কোন বানানটি গ্রহণ করব?
গ্রন্থটির অর্থায়ন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। আর এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম অভিধান প্রণয়ন, বিভিন্ন গবেষণা ও প্রকাশনা’ শিরোনামে একটি প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়েছে (গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠায় তা উল্লেখ রয়েছে বিধায় বুঝতে পারলাম) বাংলা একাডেমির জন্য। আর এ জন্য একজন কর্মসূচি পরিচালকও রয়েছেন যিনি বাংলা একাডেমিরই পরিচালক মোবারক হোসেন।
বইটিতে নামের বানান ছাড়াও আরো বহু কিছুর বানান ভুল ও একাধিক বানানে লেখা রয়েছে। এবার সেগুলো একটু দেখি।
একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধু’। এটি মূলত ড. এনায়েতুর রহিম, ড. জয়েস রহিম রচিত একটি প্রবন্ধ। এই অধ্যায়টিতেও কয়েকটি বানান আমাদের খুব পীড়া দেয়। জানি না, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও কর্মসূচি পরিচালক মোবারক হোসেনকে পীড়া দেয় কি না! একটি লাইনে আছে – ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর হৃদপি- এবং চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে’। ‘হৃদপি-’ মানে কী? অন্য একটি লাইনের অংশ বিশেষ এরকম ‘তাদের জন্য পৃথক নির্বাচকম-লী নির্ধারণ তাঁর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানেও ‘নির্বাচকম-লী’ এই শব্দটির মানে কী তা পাঠককে বুঝে নিয়ে পড়তে হবে?
উল্লিখিত প্রবন্ধের শুরুতেই লেখা আছে, ‘১১৯৬৯ সালে এদেশের জনগণ গভীর ভালোবাসায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।’ এখানে ‘১১৯৬৯’ সালটি সচেতন পাঠক হয়তো বুঝে নেবেন।
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যেকোনো মাসের তারিখের সঙ্গে লা, রা, ই, শে ব্যবহার করে না। কিন্তু, এ বইটিতে কোনো কোনো তারিখের ক্ষেত্রে একই রীতি মেনে চলা হয়নি। যেমন: (পৃ. ২৮১) আছে ১৫ আগস্ট, ২৩ জুন অথচ একই পৃষ্ঠায় আছে ২৬ শে সেপ্টেম্বর। পুরো বইয়ে এ ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে।
২৮৮ পৃষ্ঠায় ‘প্রত্যুৎপন্নমতিতা’ শুদ্ধ বানানটিকে অশুদ্ধভাবে মুদ্রিত হয়েছে ‘প্রত্যুপন্নমতিতা’। তবে ২৮৫ পৃষ্ঠায় বানানটি শুদ্ধ করেই ছাপা। এই অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ক্রিয়াপদ সম্পন্ন হয়েছে সম্মানজনক সম্বোধন করে। কিন্তু একটি বাক্যে আছে “যৌবনের প্রারম্ভিক বছরগুলোয় শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সচিব হিসেবে সমাজসেবায় অংশ নেয়।” ‘নেয়’-এর স্থানে ‘নেন’ সংশোধনের প্রয়োজন ছিল না কি?
‘হিসাব’ আর ‘হিসেবে’ তালগোল পাকিয়ে গেছে বইটিতে। কয়েকটি বাক্য দেখা যাক : চিঠিপত্র লিখে দেয়, হিসাব রাখে (পৃ. ৩১)। কয়েদিদের খালাসের সময় হিসেব করে (পৃ. ৩১)। মাল গুদামের হিসেব রাখে (পৃ.৩১)।
বইটিতে কোথাও বানানরীতির উল্লেখ না থাকলেও বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানরীতি যে অনুসরণ করা হয়েছে তা বিভিন্ন শব্দ থেকে স্পষ্ট। যেমন : হাজতি, কয়েদি, স্টেশন, কম্যুনিস্ট প্রভৃতি। এ ছাড়া শ্রেণী হয়েছে শ্রেণি, পরিপন্থী হয়েছে পরিপন্থি। এ রকম অনেক বানানই শুদ্ধভাবে মুদ্রিত হয়েছে। তাই যদি হয় অন্য সব বানানের ক্ষেত্রেও তা কি প্রযোজ্য নয়? হওয়া উচিত ম্যাজিস্ট্রেট, কিন্তু আছে ‘ম্যাজিষ্ট্রেট’ (পৃ.৩৭), আবার ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ (পৃ.৩৩) বানানটিও আছে। একাডেমির নিয়মে আছে ইংরেজি বানানে ‘st’-এর স্থলে যদি ‘স্ট’ হবে।
যেহেতু প্রমিত বাংলা বানান অনুসরণ করা হয়েছে তাহলে ‘ফ্যাক্টরি’ না হয়ে কেনো ‘ফ্যাক্টরী’ ছাপা হয়েছে? অবশ্য ‘ফ্যাক্টরী’ (পৃ.৩৫) ও ‘ফ্যাক্টরি’ (পৃ.২৮) উভয় বানানই আছে বইটিতে। এ রকম ‘আসামি’ হওয়ার কথা থাকলেও ছাপা হয়েছে ‘আসামী’ (পৃ. ৩৭)। ‘আপিল’ হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তবে ছাপা হয়েছে ‘আপীল’ (পৃ.৪১)। এই ধরনের একাধিক অসঙ্গতি চোখে পড়বে বইটিতে।
‘কারণ’ নিয়েও গোলমাল রয়েছে বইতে। আমরা জানি, ‘কারণ’ শব্দটির পর বিরাম চিহ্নের কমা (,) বসে। কোনো কোনো বাক্যে কমা দিয়েছেন আবার দেননি। যেমন : ‘কারণ, শাশুড়ি নাকি তার স্ত্রীকে নিয়ে দুইবার তালাকের জন্য এসেছে।’ এটিই শুদ্ধ। কিন্তু, একই বইয়ে একই অধ্যায়ে যখন একাধিক বাক্যে কমাবিহীন ‘কারণ’ পাই তখনই আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। যেমন- ‘কারণ যাদের হাতে ধরা পড়েছে তারা বাইরের লোক।’ (পৃ.৫২)
একই বাক্যের একটি ক্রিয়াপদের বানানের দুই ধরনের ব্যবহার। ‘আমার বাগানে সে ঝাড়ু দিতো মাঝে মাঝে; গাছেও মাঝেমধ্যে পানি দিত।’ এখানে ‘দিতো’ না ‘দিত’ কোনটি সঠিক?
বইটিতে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের পরিচিতিমূলক টীকা দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমেদের পরিচয়সূত্রে এসেছে অন্য তিন জাতীয় নেতার নাম। সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম সম্পূর্ণ এবং সঠিক বানানে লিখলেও অন্য দুজনের নাম সংক্ষিপ্ত এবং একজনের নাম ভুল বানানে লেখা হয়েছে। এ এইচ এম কামারুজ্জামানের নাম বানান লেখা হয়েছে ‘কামরুজ্জামান’।
টীকার অংশে শুরুতেই ‘ভাষা আন্দোলন’ শব্দটির দুই ধরনের উপস্থাপন পাঠকদের পীড়া দেবে। ‘ভাষা আন্দোলন’ না ‘ভাষা-আন্দোলন’? (পৃ.২৯১)। একইভাবে প্রশ্ন করা যায় ‘পূর্ব-বাংলা’ (পৃ.২৯১) না ‘পূর্ব বাংলা’ (পৃ.২৯২)?
টীকা ভাষ্যে স্বৈরাচারী শাসক মোহাম্মদ আইয়ুব খান সম্পর্কে লেখা রয়েছে পৌনে এগারো লাইন। আর জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে আছে মাত্র সোয়া ছয় লাইন। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক বলেই কি মর্যাদাহীন করে মাত্র দু লাইনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন সম্পর্কে?
এবার আসা যাক ইংরেজি বানান প্রসঙ্গে। আমরা জানি নতুন বিধি অনুযায়ী বাংলা একাডেমিতে আটটি বিভাগ আছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে- গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ (Research, Compilation, Lexicography and Encyclopedia Division)। বিভাগের পরিচালক মোবারক হোসেন। কিন্তু বইটির প্রিন্টার্স লাইনে আছে- Research, Compilation, Lexicography and ‘Excyclopedia’ Division ।
এমন ভুলে ভরা বই বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়, তবে বঙ্গবন্ধুর রোজনামচার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে বইতে স্থান পেয়েছে, যে বইয়ের ভূমিকা প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন সেই বইয়ে এমন ভুলের ছড়াছড়ি মেনে নেওয়া যায় না। এটিকে দায়িত্বে অবহেলাই বলা যায়।
বইয়ের নাম : কারাগারের রোজনামচা
লেখকের নাম : শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশক : বাংলা একাডেমি
মূল্য : ৩৬৪ টাকা
প্রকাশকাল : ২০১৭