কারাগারের রোজনামচা
দ্বিতীয় সংস্করণেও ভুল থেকে গেল
বহুল আকাঙ্ক্ষিত বই ‘কারাগারের রোজনামচা’র দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়েছে। কিছু কিছু বানান এবং প্রিন্টার্স লাইন পরিবর্তন হলেও মৌলিক সমস্যা থেকেই গেল। প্রথম সংস্করণের প্রিন্টার্স লাইনে মুদ্রক প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল 'ওয়ান স্টপ প্রিন্টশপ'। এটির স্বত্বাধিকারী কবি তারিক সুজাত। এটি সবারই জানা, বাংলা একাডেমির তালিকাভুক্ত প্রেস ছাড়া বাইরের কোনো প্রেসকে বই ছাপানো দায়িত্ব দেওয়া যায় না।
কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক ওয়ান স্টপকে সে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কেন দেওয়া হলো, আগামীবার তালিকাভুক্ত নয় এমন অন্য কোনো প্রেস এ রকম দায়িত্ব নিতে চাইলে তা দেওয়া হবে কি না সে আলোচনা পরে হবে।
দ্বিতীয় সংস্করণ একাডেমি থেকে প্রকাশ করতে পারলে প্রথম প্রকাশ কেন করা গেল না সে প্রসঙ্গেও অন্যদিন অন্য কোনো লেখায় হয়তো লেখা যাবে। একাডেমির প্রেসের আধুনিকায়ন করার জন্য সরকার থেকে যে বিরাট অঙ্কের টাকা বরাদ্দ দিয়েছে, তা কীভাবে ব্যয় হলো সেটাও না হয় অন্যদিন বলা যাবে।
আপাতত বইয়ের অসঙ্গতির দিকে আসি। প্রথমেই একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এ কারণে যে, তারা প্রিন্টার্স লাইনের Research, Compilation, Lexicography and Excyclopedia Division পরিবর্তন করে ঠিক বানান Research, Compilation, Lexicography and ‘Encyclopedia’ Division করেছে।
এ ছাড়া কিছু বানানে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু ঠিক করা হয়নি বঙ্গমাতার নাম। দ্বিতীয় সংস্করণেও ২৯৮ পৃষ্ঠার দুটি ছবির ক্যাপশনে বঙ্গমাতার নাম ছাপা হয়েছে ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা’। অথচ গ্রন্থটিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার যে ভূমিকা রয়েছে, সেখানে ছাপা হয়েছে ‘ফজিলাতুননেছা’। প্রশ্ন জাগে কেনো পরিবর্তন করা হলো না?
এনটিভি অনলাইনে ‘ভুল বানানে ভরা কারাগারের রোজনামচা’ শীর্ষক একটি রিভিউ প্রকাশ হওয়ার তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, জাতির জনকের ডায়েরিতে যেভাবে আছে সেভাবেই প্রকাশ করেছেন।
বঙ্গমাতার নাম তো ডায়েরিতে নেই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় লিখেছেন। ছবির ক্যাপশন তো একাডেমি কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। এই যুক্তি কি খাটল তাহলে?
তা ছাড়া, বইটির শুরুতে ডায়েরি থেকে যে সাতটি পাতা সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে সেখানের অনেকগুলো বানান প্রমিত বাংলা বানান রীতি অনুযায়ী শুদ্ধ করে বইয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন : হাজতি, কয়েদি, স্টেশন, কম্যুনিস্ট প্রভৃতি বানান ঈ-কার দিয়ে ছিল তা ই-কার করা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রেণী হয়েছে শ্রেণি, পরিপন্থী হয়েছে পরিপন্থি। এ রকম অনেক বানানই শুদ্ধভাবে মুদ্রিত হয়েছে। তাই যদি হয় অন্য সব বানানের ক্ষেত্রেও তা কি প্রযোজ্য নয়? প্রথম সংস্করণের মতো দ্বিতীয় সংস্করণেও সঠিক বানান ম্যাজিস্ট্রেট না ঠিক করে রেখেছে ‘ম্যাজিষ্ট্রেট’ (পৃ.৩৭), আবার ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ (পৃ.৩৩) বানানটিও আছে। একাডেমির নিয়মে আছে ইংরেজি বানানে ‘st’-এর স্থলে ‘স্ট’ হবে। কিন্তু এখানে ষ্ট কেন?
এরপর কী যুক্তি দেবেন জনাব খান?
বইটির ভূমিকায় বা কোথাও প্রকাশের পদ্ধতি নিয়ে কথা না বললেও বোঝাই যায় প্রমিত বাংলা বানান অনুসরণ করা হয়েছে। তাহলে ‘ফ্যাক্টরি’ না হয়ে কেন ‘ফ্যাক্টরী’ ছাপা হয়েছে? অবশ্য ‘ফ্যাক্টরী’ (পৃ.৩৫) ও ‘ফ্যাক্টরি’ (পৃ.২৮) উভয় বানানই আছে বইটিতে। এ রকম ‘আসামি’ হওয়ার কথা থাকলেও ছাপা হয়েছে ‘আসামী’ (পৃ. ৩৭)। ‘আপিল’ হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তবে ছাপা হয়েছে ‘আপীল’ (পৃ.৪১)। প্রথম লেখাটির মতো এবারও প্রশ্ন কেন? এর যুক্তি কী?
গ্রন্থটির অর্থায়ন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। আর এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম অভিধান প্রণয়ন, বিভিন্ন গবেষণা ও প্রকাশনা’ শিরোনামে একটি প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়েছে (গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠায় তা উল্লেখ রয়েছে বিধায় বুঝতে পারলাম) বাংলা একাডেমির জন্য। আর এ জন্য একজন কর্মসূচি পরিচালকও রয়েছেন যিনি বাংলা একাডেমিরই পরিচালক মোবারক হোসেন। তারাই বা কী জবাব দেবেন।
বাংলার এই অমূল্য সম্পদ অবহেলার দায় কি কেউ নেবেন না?
ধরে নিলাম, তৃতীয় সংস্করণে আপনারা ঠিক করবেন কিন্তু প্রথম সংস্করণে ১০ হাজার বই এবং দ্বিতীয় সংস্করণে যে আরো ১০ হাজার বই পাঠকের হাতে যাচ্ছে, যাবে তার কী হবে?
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান দয়া করে জবাব দেবেন?
বইটিতে নামের বানান ছাড়াও এখনো আরো অসঙ্গতি রয়েছে।
একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধু’। এটি মূলত ড. এনায়েতুর রহিম, ড. জয়েস রহিম রচিত একটি প্রবন্ধ। প্রথম সংস্করণে এই অধ্যায়টিতে কয়েকটি বানান আমাদের খুব পীড়া দেয়। প্রথম সংস্করণে একটি লাইনে ছিল – ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর হৃৎপিণ্ড- এবং চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে’। ‘হৃৎপিণ্ড’ মানে কী? অন্য একটি লাইনের অংশ বিশেষ এ রকম ‘তাদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর নির্ধারণ তাঁর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানেও ‘নির্বাচকমণ্ডলীর’ আমি প্রথম লেখায় প্রশ্ন করেছিলাম এই শব্দটির মানে কী তা পাঠককে বুঝে নিয়ে পড়তে হবে?
উল্লিখিত প্রবন্ধের শুরুতেই লেখা ছিল, ‘১১৯৬৯ সালে এ দেশের জনগণ গভীর ভালোবাসায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।’
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ যে এই অংশটিরও সমাধান করেছেন।
কিন্তু সমাধান হয়নি তারিখের পর কী শব্দ থাকে বা থাকে না সেটার। আমরা জানি, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যেকোনো মাসের তারিখের সঙ্গে লা, রা, ই, শে ব্যবহার করে না। কিন্তু এ বইটিতে কোনো কোনো তারিখের ক্ষেত্রে একই রীতি মেনে চলা হয়নি। প্রথম প্রকাশের মতো এটিতেও যেমন : (পৃ. ২৮১) আছে ১৫ আগস্ট, ২৩ জুন অথচ একই পৃষ্ঠায় আছে ২৬ শে সেপ্টেম্বর। পুরো বইয়ে এ ধরনের অসঙ্গতি এখনো রয়েছে।
আবারও ধন্যবাদ একাডেমি কর্তৃপক্ষকে তারা ২৮৮ পৃষ্ঠায় ‘প্রত্যুৎপন্নমতিতা’ শুদ্ধ বানানটিকে অশুদ্ধভাবে মুদ্রিত করেছিল এবার ঠিক করা হয়েছে।
এই অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ক্রিয়া পদ সম্পন্ন হয়েছে সম্মানজনক সম্বোধন করে ‘নেয় এবং নেন’ সংক্রান্ত জটিলতারও অবসান হয়েছে।
আগে ছিল “যৌবনের প্রারম্ভিক বছরগুলোয় শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সচিব হিসেবে সমাজসেবায় অংশ নেয়।’ ‘নেয়’-এর স্থানে ‘নেন’ সংশোধনের প্রয়োজন ছিল তা তারা করেছে।
কিন্তু ‘হিসাব’ আর ‘হিসেবে’ নিয়ে যে জটিলতা ছিল তা বইটিতে এখনো রয়ে গেছে। যেমন : চিঠিপত্র লিখে দেয়, হিসাব রাখে (পৃ. ৩১। কয়েদিদের খালাসের সময় হিসেব করে (পৃ. ৩১)। মাল গুদামের হিসেব রাখে (পৃ.৩১)। হিসেব আর হিসাবের অর্থ একই থেকে গেল।
‘কারণ’ নিয়েও গোলমাল ছিল তার সমাধান এখনো হয়নি। আমরা জানি, ‘কারণ’ শব্দটির পর বিরাম চিহ্নের কমা (,) বসে। কোনো কোনো বাক্যে কমা দিয়েছেন (পৃ. ৫২) আবার দেননি (পৃ.৫২)। যেমন : ‘কারণ, শাশুড়ি নাকি তার স্ত্রীকে নিয়ে দুইবার তালাকের জন্য এসেছে।’ এটিই শুদ্ধ। কিন্তু একই বইয়ে একই অধ্যায়ে যখন একাধিক বাক্যে কমাবিহীন ‘কারণ’ পাই, তখনই আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। যেমন- ‘কারণ যাদের হাতে ধরা পড়েছে তারা বাইরের লোক।’ (পৃ.৫২)
প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর লিখেছিলাম। বইটিতে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের পরিচিতিমূলক টিকা দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদের পরিচয়সূত্রে এসেছে অন্য তিন জাতীয় নেতার নাম। সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম সম্পূর্ণ এবং সঠিক বানানে লিখলেও অন্য দুজনের নাম সংক্ষিপ্ত এবং একজনের নাম ভুল বানানে লেখা হয়েছে। এ এইচ এম কামারুজ্জামানের নাম বানান লেখা হয়েছে ‘কামরুজ্জামান’। এটি এখনো এভাবেই আছে।
টিকার অংশে শুরুতেই ‘ভাষা আন্দোলন’ শব্দটির দুই ধরনের উপস্থাপন পাঠকদের পীড়া দেবে। ‘ভাষা আন্দোলন’ না ‘ভাষা-আন্দোলন’? (পৃ.২৯১)। একইভাবে প্রশ্ন করা যায় ‘পূর্ব-বাংলা’ (পৃ.২৯১) না ‘পূর্ব বাংলা’ (পৃ.২৯২)? দ্বিতীয় সংস্করণে এমন লেখা দেখে আবার এই একই প্রশ্ন, কোনটা সঠিক?
প্রথম সংস্করণে টিকা ভাষ্যে স্বৈরাচারী শাসক মোহাম্মদ আইয়ুব খান সম্পর্কে লেখা ছিল পৌনে এগারো লাইন। আর জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে ছিল মাত্র সোয়া ছয় লাইন। এখনো তাই আছে।
এমন ভুলে ভরা বই বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বাংলা একাডেমিতেও এমন আরো বই আছে। তবে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচার মতো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে এমন ভুল অমার্জনীয়। যে বইয়ের ভূমিকা প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, সেই লেখায় ভুল রাখা একাডেমি কর্তৃপক্ষের ধৃষ্টতা বটে। কিন্তু কার স্বার্থে, কোন উদ্দেশ্যে এই অবহেলা এ রকম প্রশ্ন অনেকের।
বইয়ের নাম : কারাগারের রোজনামচা
লেখকের নাম : শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশক : বাংলা একাডেমি
মূল্য : ৪০০ টাকা
প্রকাশকাল : ২০১৭