দগ্ধতা অথবা বাষ্পিত হওয়ার গল্প
মুরগীর রান জ্বলছে আর নিভছে। জ্বলে উঠা এবং নিভে যাওয়ার মধ্যে আছে লোভ উসকে দেয়ার মতলব। রেস্টুরেন্টের সামনে মোটরগাড়ির দীর্ঘ লাইন বলছে মতলব হাসিল হয়েছে। মুরগীর রান চেখে দেখতে আসা কেউ কেউ মোটরগাড়ি ভেড়াতে না পেরে চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো গাড়িকে রেস্টুরেন্টের সামনে এক-দুইবার চক্কর দিতেও দেখা গেল। রেস্টুরেন্ট থেকে যারা বের হচ্ছে তাদের ঢেঁকুরের আওয়াজ শোনার ইচ্ছে হলো ধ্রুপদের। গাড়ির কালো কাঁচ ভেদ করে যেমন ভোগকারীদের দেখা গেল না, তেমনি ঢেঁকুর শব্দও সড়কদ্বীপ পেরিয়ে ধ্রুপদের কানে এসে পৌঁছল না। ধ্রুপদ এসেছে মুরগির রানে কামড় দেওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়ে। সরাসরি রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ার সাহস জোগাতে পারেনি ও। এমন অভিজাত পাড়া দিয়ে হেঁটে চলার অভ্যাস আছে। পকেটের বিলাসী দিনে স্মৃতি আছে রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর। কখনো কারো নিমন্ত্রনে বা ভুলে রাজসিক এমন রেস্টুরেন্টের শীতল হাওয়া গায়ে মাখার সুযোগ হয়নি। ঝুমার ডাকে আসা। এই রেস্টুরেন্ট ঝুমার বাসাবাড়ি বলা যায়। ফেইসবুকে কোনোদিন বাকি নাই, যেদিন এই রেস্টুরেন্ট থেকে ঝুমা ‘চেক-ইন’ দেয়নি। এই ‘চেক-ইন’ দেখতে দেখতেই ঝুমাকে কড়া নাড়া। প্রথম ডাকেই সাড়া মিলে। তবে ইনবক্সে গিয়ে আড্ডা জমানোর মানুষ নয় ও। শুধু সেলফি আর ‘চেক-ইন’। মাঝে মধ্যে ইনবক্সে দুইএক বাক্য ব্যয় করে। এখানে ঝুমা’র সঙ্গে কখনো কোনো পুরোন মুখ দেখেনি ধ্রুপদ। প্রতিদিনই খাবার টেবিলে নতুন সঙ্গী। মুরগির রান হাতে কামড় দেওয়ার আগ মুহূর্তের ছবিটা ফেসবুক দেয়ালে তুলে দেয় ঝুমা। পোশাক পুরোনো পাওয়া গেছে, কিন্তু মুখগুলো নতুন। আজ ধ্রুপদের তেমন এক নতুন মুখ হতে আসা।
ঝুমার দাবি, ও খুব ভালো পাঠক। অল্প সময়েই মানুষকে পড়ে নিতে পারে। পুরুষের চোখে-মুখে যা লেখা থাকে সেটি সন্ধ্যা ভাষায় লেখা নয়। খুব সহজেই পড়ে নেওয়া যায়। একবার কেউ এসে সামনে বসলেই হলো, পড়ে নেওয়া যায় পাতার পর পাতা। কোনো কোনো পাতায় একটু ঘোর-প্যাঁচ থাকে, কিন্তু ঝু্মার অভিজ্ঞ চোখের কাছে তা দুর্গম নয়। এতদিনে বুঝি রেস্টুরেন্টের বয়-বেয়ারাগুলোও বুঝে গেছে। ঝুমার অতিথিরা এলে তারাও যেন একটু পড়ে নিতে চায়। ঝুমার সেখানেও আনন্দ। যাক মানুষগুলো তাহলে কাগজের বাইরেও কিছু লেখা পড়তে শিখছে। সব মুখকে ঝুমার গ্রন্থ মনে হয় না। কোনো কোনোটা চিরকুট। এক দুই লাইনে লেখা। সাব্বিরের কথাই বলা যায়। ফেইসবুকে টাইমলাইন দেখে সাব্বিরকে বড়শিতে বাঁধার কথা ভাবে। ছেলেটার টাইমলাইন বেশ দুর্বোদ্ধ। মুহূর্তেই নিজেকে কেমন পাল্টে ফেলে। এক ঘণ্টা আগের সাব্বিরের সঙ্গে পরের ঘণ্টার সাব্বিরের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথাও বন্ধু-বান্ধব মিলে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে ফেলেছে। পরের পোস্টেই দেখা গেল বিষণ্ণ সাব্বিরকে। পৃথিবী তার কাছে অচেনা গ্রহ। এই গ্রহ ত্যাগের জন্য সে তৈরি। সাব্বিরের জন্য মনটা যখন আর্দ্র হয়ে আসছে, তখনই কোনো অপ্সরীর সঙ্গে তার সেলফি। ঝুমা থমকে যায়। ও আরো দ্বিধায় পড়ে যায় যখন সাব্বির ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে টাইমলাইনে কট্টরপন্থীর ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। ওকে নিয়ে তর্কাতর্কিতে চোখ বুলাতে বুলাতেই সামনে চলে আসে-ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাব্বিরের যৌক্তিক অবস্থান। ঝুমা ধারণা করে ছেলেটির দ্বৈত অবস্থান আছে। নিজের মধ্যে দ্বৈত সত্তা কাজ করে। তাই সাব্বিরকে ডেকে এনেছিল। আষাঢ় মাসের তাপে ঘামছিল সাব্বির। শীতল রেস্টুরেন্টে ঢুকে কেমন উস্কোখুস্কো অবস্থা তার। মনে হচ্ছিল এমন পরিবেশের সঙ্গে সেদিনই প্রথম পরিচয়। ঝুমা দেখতে পায় সাব্বির কোনো পুষ্ট পেপারব্যাক নয়। দুই লাইনের চিরকুট মাত্র। স্পষ্ট লেখা— কারো তামাশা আমাকে পৃথিবীতে এনেছে। আমি তার প্রতিশোধে তামাশায় কাটিয়ে দেব জীবন।
জোসেফকে বরং তার টাইমলাইনে চিরকুটের মতো মনে হয়েছে। ছেলেটার জীবন নিয়ে কোনো গভীর ভাবনা নেই। ছত্রাক ভাবনা। কোনো কিছুতে থাকলে আছি, না থাকলে নেই। জোসেফের পোস্ট করা ছবিতে ওর চারপাশের জীবনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো বন্ধুর সঙ্গে ছবি নেই। পোস্ট করা ছবিতে জোসেফ একা। পোশাকের বদল ছাড়া প্রতিকৃতিতে আর কোনো পরিবর্তন নেই।
ঝুমা সাব্বিরকে ডেকে আনে। রেস্টুরেন্টের বারান্দায় যেখানে ঝুমা বসে নিয়মিত, তার পাশেই রাস্তা। জোসেফ খুব দামি মোটরসাইকেল নিয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওপর থেকেই তার হাতের মাসলের চূড়া দেখতে পায় ঝুমা। চোখে সানগ্লাস থাকায় চোখ পড়া শুরু করতে পারেনি। জোসেফ যখন ঝুমার টেবিলের সামনে, সানগ্লাস তখন হাতে। চমকে ওঠে ঝুমা। একি দেখছে সে। এ তো বাঁধাই করা পুরু একটা বই। মুখবন্ধ বলছে, জীবনকে প্রকাশিত করার প্রয়োজন নেই। তাতে অপচয় হয় জীবনের। নারীকে তুমি স্পর্শ করে দেখো, মেঘ হয়ে ঝরে পড়বে সবটুকু জল। ঝরে পড়বে বিশ্বাস, ভালোবাসা। তাই কি দরকার তাকে স্পর্শ করার। দূরে থাকো। মেঘ ঘুড়ি হয়ে উড়ে বেড়াক জীবনের আসমানে।
ধ্রুপদকে ঝুমা বলেছে, ওর একজন পুরুষ চাই। যেই পুরুষ ওকে স্পর্শ করবে, কিন্তু ভালোবাসা নর্দমার ভেসে যাবে না জল হয়ে। কত পুরুষকেই ডেকে আনা হয়েছে। তারা স্পর্শ করতে চেয়েছে। অবশ্যই ঝুমার মতো করে নয়। তাদের নিজেদের স্বাদের মতো করে। এই রেস্টুরেন্টেই ঝুমার আরো দুই বান্ধবী এসে বসে। তারাও পুরুষ ডেকে আনে। দুজনেই স্পর্শ নিয়ে মেতে আছে। সেই স্পর্শ চিৎকার হয়ে কানে এসে আঘাত করে যায় ঝুমাকে। সেখানে একবিন্দু ভালোবাসার জল নেই। ঝুমা দেখছে, ওর দুই বান্ধবীই কেমন যেন খরখরে হয়ে গেছে। কারা যেন শুষে ওদের। ওরা জানতে পারছে না। চারদিকে মিথ্যে ভোগসংগীত বেজে যাচ্ছে, সেখানে ওরা দুজন ডুবে আছে। সবুজ পাটের মতো। ঝুমা জানে যেদিন সেই সংগীত থেমে যাবে, সেদিন শুকনো পাটকাঠি হয়ে রোদে দগ্ধ হবে ওরা।
ঝুমা ধ্রুপদকে সরাসরিই বলেছে, ওর স্পর্শ চাই। কোনো ভণিতা করেনি। স্পর্শ নিয়ে জীবনে কত ছলনা—নাটক দেখতে পায় ঝুমা। কেউ অকপটে বলে দিতে পারছে না—তার কী চাই। ধ্রুপদকে পাঠানো ঝুমার দ্বিতীয় বাক্যটিই ছিল—স্পর্শ চাই। দেবে? ধ্রুপদ বুঝে উঠতে পারেনি। এ কেমন স্পর্শের জন্য আকুতি। সমাজ আজকাল যতই ঘেরাটোপে নিজেকে আটকানোর ভান করুক না কেন, ধ্রুপদ জানে কী এক ভাঙন শুরু হয়েছে। এই ভাঙন একের পর এক বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। ঘেরাটোপের আড়ালে এক উন্মুক্ত জলাশয় দেখতে পায় ধ্রুপদ। ঝুমাকে সেই জলাশয়ের হংস মনে হয় তার। নিজেকে যোগ করে জলাশয়ে মিথুন ক্রীড়ার স্বপ্ন বুনে ধ্রুপদ। তবে নিজেকে নিয়ে তার দ্বিধার অন্ত নেই। স্পর্শ করতে শিখেছে কি ও? শরীরের সঙ্গে শরীরের দেখা হলেই তো আর স্পর্শ হয় না, সেখানে বালুবেলার ধুলো উড়ে। বয়ে যায় নদীর অজানা স্রোত। ঝুমাকে বলেছিল ধ্রুপদ—ধূলিঝড় হবে। মেঘ ভেঙে আসবে না। আকাশে সাতরং ভেসে ওঠার সম্ভাবনাও নেই। ঝুমার জেদ ইনবক্সে কাঁপন ধরায়—চাই। চাই। ভয় কি? যদি শুকনসো পাতা হও উড়ে যাবে ধূলিঝড়ের সঙ্গেই। পতিত হবে কোনো মজা পুকুরে। সেখানে শিং মাছের সঙ্গে হবে তোমার ভাব। সেই স্পর্শ নিশ্চয়ই খুব রোমাঞ্চের।
ঝুমার তাচ্ছিল্যের জবাব দিতেই ধ্রুপদ এসেছে। দেরি হয়ে গেছে অনেকটা। ঝুমা এরই মধ্যে ছয়বার ফোন দিয়ে ফেলেছে। ধ্রুপদ ফোন ধরেনি দেখে এসএমএস করেছে। কী দেরি কেন, মসলা মাখছো? ধ্রুপদ মুরগির রানের দিকে তাকায়। কেমন সুস্বাদু মসলা মাখা রানটি। বাতি যখন নিভে যায়, ধ্রুপদ সেখানে নিজেকে দেখে। মুরগির রান এবং ধ্রুপদ, দুটির জন্যই শহরে এই রেস্টুরেন্টের নামডাক!