মুক্তগদ্য
স্মৃতির বাকসোতে ঈদ
কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা সেতু পার হতে গিয়ে মনে পড়ল এক ভোরের কথা। কুয়াশা ভেঙে সূর্য কেবল উঁকি দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিল। আমি ডিঙি নৌকায়। খেয়া পারাপারে মাকে আঁকড়ে আছি। ঢেউয়ের দুলোনিতে ডুবে যাওয়ার শঙ্কা। নদীর ঢেউয়ের ওঠানামায় বুক কাঁপছে আমার। কিন্তু চোখ তন্ময় হয়ে আছে আনকোরা সূর্যের আলোয় নদীর রুপালি শরীর দেখে। রূপ ঠিকরে পড়ছে। ঢাকা থেকে নরসিংদী যাব। মাঝে শীতলক্ষ্যা। ওপারে বাস অপেক্ষা করছে। ভুঁড়িওয়ালা বাস। ভুঁড়ি ছাড়াও আছে। আমার লোভ ভুঁড়িওয়ালা বাসের দিকে।
সকালে বাড়ি থেকে যারা নাশতা করে বের হতে পারেননি, তারা নৌকায় বসে পাউরুটি-কলা খেয়ে নিচ্ছে। কেমন নরম ও মিষ্টি গন্ধ আছে পাউরুটির। আমরা খিচুড়ি খেয়ে বের হয়েছি। সবজি খিচুড়ি। তবুও পাউরুটির সৌরভে খিদে চড়াও হয়ে উঠছে। নৌকা থেকে নামতেই খিদের কথা ভুলে গেলাম। আমরা নদী পার হওয়ার আগেই ভুঁড়িওয়ালা বাসযাত্রীতে ভর্তি হয়ে গেছে। আমাদের মতো আরো অনেক পরিবার উঠার সুযোগ পায়নি। ভুঁড়িছাড়া আরেকটি বাস ছিল, সেটি আরো আগে ছেড়ে চলে গেছে। ভটভট করে ভুঁড়িওয়ালাও চলে গেল। পরের বাস কখন আসবে, কেউ জানে না। এখন রওনা না হতে পারলে নরসিংদী গিয়ে ১০টায় ছেড়ে যাওয়া লঞ্চ ধরা মুশকিল হয়ে পড়বে। পরের লঞ্চ বারোটায়। ওই লঞ্চে উঠলে রাতের আগে বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব হবে না। উপায় আছে যদি ট্রাকে উঠে পড়া যায়। কয়েকটি পরিবার ট্রাকে উঠেও পড়েছে। আমাদেরও বলছে উঠে পড়তে। কিন্তু বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
আমাকে আর ছোট বোনকে নিয়ে ট্রাকে উঠতে চাইছেন না। আর এমন করে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও নেই আমাদের। আকাশে মেঘের সাজসজ্জা দেখে ভয় আরো বাড়ছিল। ট্রাকে চড়লে নরসিংদী পৌঁছার আগেই কাকভেজা হওয়ার শঙ্কা আছে। তবুও ট্রাকে চড়ে বসতে হলো আমাদের পরিবারকে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম। একদম মায়ের হাঁটুতে মুখ বুজে। মা আঁকড়ে ধরে রাখলেন বোনকেও। ট্রাক চলছে তার চরিত্র মতোই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখি, আমাদের ট্রাক যাত্রা দেখে হাসছে ফিকফিক করে। অতএব, বৃষ্টির ভয় নেই। হলেও মন্দ হতো না। ট্রাকে ভিজে ভিজে যাওয়া। এটা আমার ভাবনা ছিল। বুঝতে পারছিলাম বৃষ্টি নামলে মা এবং অন্যদের দুর্ভোগ বাড়বে। দুই পাশে প্রশস্ত খাল। এখনকার অনেক নদীর চেয়ে চওড়া। খালে কচুরি ফুল ফুটে আছে।
কোথাও কোথাও মাছ ধরতে দেখলাম জেলেদের, আমার বয়সী ছেলেমেয়েরাও কাদাপানিতে নেমে গেছে। কিছুদূর যেতেই রাস্তার দুই পাশে কাপড় শুকাতে দেওয়া। কাপড়ের হাটও দেখলাম। বয়স বাড়লে জেনেছি জায়গাটির নাম মাধবদী। হাটের নাম বাবুর হাট। ট্রাক নরসিংদীর কাছাকাছি পৌঁছতেই পাটের গন্ধ এসে নাকে ধরা দেয়। বইত তখন মাত্র পড়তে শুরু করেছি সোনালি আঁশের কথা। ট্রাক থেকে নেমে লঞ্চঘাটের দিকে যেতে সরু রাস্তার দুই দিকের পাটের গুদাম। পথে ছড়ানো ছিটানো পাট। লঞ্চঘাটে পৌঁছে দেখি পুরো টার্মিনাল লোকে লোকারণ্য। লঞ্চ ঘাটে ভেড়েনি। মাঝ নদীতে নোঙর করে আছে। নৌকায় করে গিয়ে লঞ্চে উঠতে হবে। ভয় লাগল।
মেঘনায় বড় ঢেউ দেখে নৌকায় উঠতে রাজি হচ্ছিলেন না মা। বাবা ছাড়া আমরা কেউ সাঁতার জানি না। কিন্তু সবাই যখন উঠছে তখন উঠতেই হলো। নৌকায় উঠে দেখি আশপাশের নৌকায় যাত্রীদের পাশাপাশি প্রচুর কলা। মনে পড়ল মা বলেছিলেন, নরসিংদী সাগর কলার জন্য বিখ্যাত। লঞ্চে উঠে আমরা কেবিনে জায়গা পেলাম না। বারান্দা বা ডেকও খালি ছিল না। জায়গা হলো ইঞ্জিন রুমের পাশে নিচতলায়। ভয় গেল বেড়ে। হাত বাড়ালেই নদী ছোঁয়া যায়। আবার ঢেউও ঢেঁকুর তুলে লঞ্চে চলে আসতে পারে। তবে লঞ্চের ইঞ্জিনের দিকে মনোযোগ দেওয়াতে আমার ভয় কেটে গেছিল।
একেকটি ঘাটে লঞ্চ ভিড়ে আর আমি জানালায় মুখ রাখি। কতো দৌড়ঝাঁপ করে বাসে, ট্রাকে, লঞ্চে বাড়ি পৌঁছাল, কিন্তু কারো মুখে ক্লান্তি নেই। সবার চোখমুখে বাড়ি ফেরার আনন্দ। আমিও নদীর তীরের মানুষদের দেখি অবাক হয়ে। ওদের নদীতে ঝাঁপ দেওয়া, গোসল করা, নদীর তীর ধরে গুন ধরে নৌকা টেনে নেয়া, গরু-মহিষকে গোসল করানো কতো সুন্দর। কোথাও কোথাও নদীর পাড়ে বা লঞ্চঘাটে একলা দাঁড়ানো কোনো তালগাছ, বট-অশ্বথ, হিজল বা জামগাছ দেখে চমকে উঠেছি। মনে হয়েছে কত ভালোবাসা নদীর সঙ্গে গাছটির। ইচ্ছে হয়েছে নেমে পড়তে। বসে থাকতে গাছের ছায়ায়। হয়নি। দারুণ স্বাদের চানাচুর আর চা খেয়ে আমি সারেং ঘরে উঠে গেছি। কতদূর… আর কতটা পথ আমার প্রিয় ঘাট মানিকনগরের।
লঞ্চঘাটে ভিড়তেই লাফিয়ে পড়েছি পন্টুনে। সরাসরি মিষ্টির দোকানে। বড় রসগোল্লা খেয়ে তারপর নৌকার দিকে দৌড়। মেঘনা থেকে যে খালটি শ্যামগ্রামের দিকে গেছে, সেই খাল ধরেই আমার গ্রাম খাগাতুয়া। খালের হিজল রঙ প্রশান্ত জল ছুঁয়ে রেখেছি নৌকা যতক্ষণ বাড়ির ঘাটে পৌঁছেছে। শ্যামগ্রাম পেরোতে গিয়ে নেমে গেছি বাজারে। লেবা দার দোকানে গিয়ে লালমোহন খেয়ে নিয়েছি ২/৩টা। সঙ্গে ঘোল। স্কুলের পুকুরে গিয়ে ঢিল ছুড়লাম। মাছরাঙা এসে চোখ রাঙানি দিয়ে গেল। মনে হলো ওর রাজত্বে আমার প্রবেশ মেনে নিতে পারেনি। মাছেরাও দৌড়ঝাঁপ করল। পুকুরে জামরুল ভেসে আছে। মুঠো ভর্তি করে নিয়ে পুরোনো মঠ দেখে আবার নৌকায় উঠি।
শালুক, শাপলা আর কচুরি ফুল তুলতে তুলতে নৌকা এগিয়ে যায় পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে বিলের কোনাকোনি। ধোপাবাড়ি পার হতেই নজরে আসে আমার গ্রামের বাজার। বাজারকে ঢেকে রাখা অশ্বথ। আমাদের মতো অনেকেই বাড়ি আসছে ঈদে। পাশ দিয়ে তাদের নৌকা যাচ্ছে আমাদের ডিঙিয়ে। কোন নৌকা পাশাপাশি। হয়তো কেউ পাশের গ্রামের। কুশল বিনিময় হচ্ছে। আগাম নিমন্ত্রণ ঈদের দিনের। বাবা মাঝির কাছ থেকে গ্রামের খবরা খবর নিয়ে নিচ্ছেন। ধান কেমন হলো। পাট কেমন হবে। পুজো কেমন হয়েছে। ঈদগা তৈরি কি না। কোন কোন বাড়ির অসুস্থ মানুষের খবরাখবর। ঈদ করতে গ্রামে কারা কারা এরই মধ্যে চলে এসেছেন। দেখলাম মাঝি সবার বাড়ির হাঁড়ির খবর রাখেন। শুধু আমাদের গ্রামেরই নয়, আশপাশের দশ-বারোটা গ্রামের সব খবর তার জানা। গ্রামের বাজার পেরিয়ে যাওয়ার সময় সবাই বাবাকে ডাকাডাকি করছে। কেউ কেউ আমাকেও। আবারও মিষ্টি খাওয়ানোর লোভ। কিন্তু গোধূলির আলোতে দেখা যাচ্ছে মেঘরঙ জমিন আর সিঁদুর রঙা শাড়ি পরে বাঁশঝাড়ের নিচে একজন দাঁড়িয়েছেন। তার কাছেই ছুটে যেতে হলো। তার বুকেই আছড়ে পড়লাম।
তারপর বাড়ির উঠোনে তেলেসমতি কাণ্ড। কোরবানির জন্য রেখে দেওয়া গরুর সজল চোখ আমাকেও আর্দ্র করেছে। কিন্তু গাছ ভরা অড় বরই, পুকুরের পদ্ম, সেগুন গাছে ঝুলিয়ে রাখা পাটখড়ি, লতানো গোলাপ, বারান্দার ছাদে বেয়ে ওঠা মাধবীলতা, উঠোনের একপাশের মাচায় ঝুলে থাকা শসা, তার নিচে কচুরলতি দেখে মাতোয়ারা আমি। এক হাতে পাকোয়ান পিঠা, অন্য হাতে মুড়ির মোয়া। সমবয়সীদের নিয়ে তখনই গ্রাম ঘুরে দেখতে বের হচ্ছি, নৌকা তৈরি। এমন সময় দাদা এসে হাতে টিন ধরিয়ে দিলেন। গ্রাম ঘুরে টিন পিটিয়ে জানাতে হবে ঈদের জামাতের সময়। নৌকা নিয়ে ছুটলাম। খাল, পুকুর পেরিয়ে । অন্ধকার রাত। অমাবস্যা। নৌকার হারিকেনে পথ চলি। আমার কণ্ঠ শুনে কেউ কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ ছোট হুজুর বলে ডাকও দেয়। দাওয়াত করল কোনো কোনো বাড়ি থেকে। নগদ পেয়ারা-পিঠাও মিলল। পুরো গ্রাম জানিয়ে দিয়ে মসজিদের মিনারে উঠে পড়ি। মাইকে শেষ ঘোষণা। ততক্ষণে মধ্যরাত হয়ে গেছে। ফিরে দেখি দাদি-মা-চাচিরা চালের গুঁড়া দিয়ে সেমাই বানাচ্ছে। ক্লান্ত আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, বুঝতেই পারিনি। সকালে নৌকায় ঈদগাহ যাত্রা। খালে নৌকার ভিড়। সব নৌকা মসজিদের দিকে যাচ্ছে। পথে কুশল বিনিময়। ঈদের আগে কে কখন বাড়ি এলো, কবে ফিরবে? এই আলোচনা। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে কোরবানি শেষ করে আবার গ্রাম ভ্রমণ, বাড়ি বাড়ি কোরবানির মাংস বিতরণ। ঈদের দিন দুপুরের এই নৌকা ভ্রমণের আনন্দকে আর কোনো ভ্রমণ এখনো ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। বাজারে গিয়ে জিলাপি কিনে বেরিয়ে পড়তাম। বাড়ি বাড়ি মাংস বিলি করতে গিয়ে গ্রামের সবার সঙ্গে দেখা, পরিচয় হতো। রাতে বাড়ি ফিরে সদ্য রান্না করা মাংস আর চালের রুটি। এমন জিভ হরণ করা খাবার, আর কবে খেয়েছি? না জিভ পেতে বসে থেকেও সেই স্বাদের দেখা পাইনি। যেমন চোখ পেতেও আর দেখতে পাইনি ভরা আষাঢ়ে নৌকায় গ্রামের বিল পাড়ি দিয়ে শ্যামগ্রাম মিষ্টি খেতে যাওয়া, কিংবা রতনপুরে নৌকাবাইচ দেখতে যাওয়া। আমার কৈশোরের ঈদ স্মৃতি বাকসো খুলে দেখি, যখন তখন। ইচ্ছে হলেই। তাই ঈদ আমার হাতের মুঠোতেই থাকে। চাইলেই সেই বাকসো খুলে বসে পড়ি আমি।