স্মরণ
জীবনানন্দ ও জীবনের ছন্দ
আজ ২২ অক্টোবর। আধুনিক বাংলা কবিতার, কথাটা শুধরে বলি, বিশ্ব আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রাণপুরুষ জীবনানন্দের প্রয়াণ দিবস। ঠিক ৬২ বছর আগে এই দিনে তাঁর বিদায় ছিল আকস্মিক, অকালীন তো বটেই। মাত্র ৫৫ বছর বয়স হয়েছিল। তাঁর শারীরিক মৃত্যু নিয়ে নানা কথা আছে। ট্রাম দুর্ঘটনার বিষয়টিকে অনেকেই স্বেচ্ছামৃত্যু হিসেবে দেখেন। মৃত্যুপূর্ববর্তী কবির আচরণ বিশ্লেষণ করলে অনেকের কাছে এটা সত্যি বলে মনে হতে পারে। যদি তিনি আত্মহননের পথ বেছেও নিয়ে থাকেন তাহলেও তার জন্যে দুষতে হবে এই পৃথিবীকেই। স্পষ্ট করে বললে তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজকেই।
বিপুল বিরূপতা, বিরুদ্ধতা ও বিপর্যস্ততার (উচ্চশিক্ষিত হয়েও বারবার উপার্জনহীন থাকা, কবিতা না বুঝে কুৎসিত বিরুদ্ধাচরণ, অসুখী দাম্পত্য ইত্যাদি) ভেতরেও নিজেকে কবিতামণ্ডপে স্থিত রেখে তিনি যে সোনার ফসল ফলিয়ে গেছেন সে জন্যে বরং আমাদের গভীর কৃতজ্ঞ হওয়ার আছে। তাঁর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া বরং অসমীচীন। এই সঙ্গে আরেকটু যোগ করে বলব, তাঁর কবিতা বরং মানবজাতির আত্মহননেচ্ছার বিপরীতে এক সুগভীর সান্ত্বনা ও শুশ্রুষা। পৃথিবী এখন অশ্লীল এক বিপণিবিতানের রূপ নিয়েছে, এখানে রক্তপাত ঘটছে নানা ছুতোয়; সংবেদী ব্যক্তি আরো বেশি নিঃসঙ্গ, অসুস্থতার বিচিত্র তীর তার দিকে তাক করা। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র কবিতাই দিতে পারে গহিনের আরাম, সংহত সান্ত্বনা। অবশ্য এ প্রাপ্তির রকমফের ও মাত্রাবিভাজন আছে। সবচেয়ে সার্থকভাবে যে কজন কবির কবিতা পৃথিবীবাসীকে পরমনির্ভর সান্ত্বনা ও অনির্বচনীয় সুখ দিতে পারে, তাদের ভেতর বাংলা ভাষার কবি জীবনানন্দ দাশ সন্দেহাতীতভাবে প্রধান।
তবে তাঁকে ছাঁচে ফেলে ছেঁটে ফেলার প্রবণতা আজকের দিনেও লক্ষণীয়। বিশেষণের বহর প্রয়োগ বরং তাঁকে সীমাবদ্ধ করারই নামান্তর। যদি তাঁকে কেউ অমঙ্গল চেতনার কবি বলেন, তাহলে সবিনয়ে তাকে বলব, রাত্রির অন্ধকার না বুঝলে দিবসের সূর্যকে কী উপায়ে শনাক্ত করবেন? আর নির্জনতার কবি! কোন শিল্পী নির্জন নন তাঁর সৃজনের প্রাঙ্গণে? জনতার ভেতর গাড়লগোষ্ঠী মিলবে ঢের, কবি কয়জনা? তাই জনতার বা নির্জনতার কবি বলে তকমা আঁটা কেন!
এটা মানতেই হবে বিশ্বের কোটি কোটি ব্যক্তির জীবন পার হয়ে যাচ্ছে কবিতা নামক ধ্রুপদী শুদ্ধতার সান্নিধ্য বিনা। কিন্তু যারা ভাগ্যবান ও রসবেত্তা, তাদের সমীপে জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থস্বরূপ। এটির প্রতিটি কবিতা নিয়ে বহুবিশ্লেষণ হয়েছে। ষাটের দশকে কবিতা পরিচয় পত্রিকায় চারজন কবি, কবিতা-সমালোচক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকার এবং মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় পরস্পরবিরোধী চার রকম বিবেচনা ও ব্যাখ্যা করেছিলেন এই গ্রন্থের ‘গোধূলি সন্ধির নৃত্য’ কবিতাটির। রোমান্টিক বা প্রাক-রোমান্টিক ধারায় তো নয়ই এমনকি রোমান্টিকোত্তর অর্থ-নয়-ইংগিত এই নান্দনিকেও জীবনানন্দের এ কবিতাটি, অর্থ এবং মর্ম বিবেচনায়, তাঁর প্রায় সমগ্র কবিতাবলির মধ্যে কুয়াশাতম এমন মন্তব্য এ কালের সমালোচকের।
কিন্তু তবু মানতেই হবে কবিতাটি উদ্দীপ্ত করতে পারে অদ্ভুত কুহকে, সম্মোহনে, বাস্তবতায়, পরাবাস্তবিকতায়। এককালে বাঙালি কবিরাই কেবল জীবনানন্দের একনিষ্ঠ মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। এখন কবিতার পাঠকমাত্রই জীবনানন্দের অনিবার্য পাঠক এমন কথা বলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি। জীবনানন্দের প্রয়াণ দিবসটিকে সামনে রেখে রাজধানীতে একবার একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজিত হয়েছিল। ওটি সত্যিই এক অভিনব উদ্যোগ, প্রশংসনীয় তো বটেই। ত্রিশের অধিক কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক-কথাশিল্পীর সক্রিয় অংশগ্রহণে ওই বৈঠকটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বলা দরকার আয়োজক কর্তৃপক্ষ ছিল জাতীয় জাদুঘর। সরকারি ওই সংস্থাটির মহাপরিচালক জীবনানন্দপ্রেমিক ও ব্যতিক্রমী গবেষক বলেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন একটি অভিনিবেশমন্দ্রিত আয়োজন সফল করতে পেরেছেন। আশা করছি ওখানে উঠে আসা বক্তব্য আরো সংহত রূপ পাবে অংশগ্রহণকারীদের শ্রমনিষ্ঠ কলমে এবং ভবিষ্যতে তা গ্রন্থরূপ লাভ করবে। সুযোগ পেয়ে আমি এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা সে সভায় করি, যা প্রায় অনুচ্চারিত ও অনালোচিত প্রসঙ্গ। প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করেই এখানে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি।
তবে তার আগে উল্লেখ না করলেই নয় যে, আমারই মতো নিশ্চয়ই বহু লেখক মনে করেন আমাদের এই বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সঙ্গে এক পঙক্তিতে উচ্চারণযোগ্য নাম জীবনানন্দ। জাতীয় কবি, জাতীয় সংগীতের কবি এসব রাষ্ট্রীয় কোটা পূর্ণ হয়ে গেছে ইতোপূর্বেই। যদিও জীবনানন্দ অধিষ্ঠিত রয়েছেন কবিতাপিপাসুদের প্রাণের গভীরে। জাতীয় পর্যায়ে এবং মিডিয়ায় ও হাঁটে-বাটে-মাঠে রবীন্দ্র-নজরুল বহুল উচ্চারিত, পঠিত এবং শ্রুত। এমনকি তাঁদের গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপও ব্যাপকভাবে অভিনীত। এই দুই মহৎ মনীষীর ব্যাখ্যা ও বন্দনায় ফিবছর নিবেদিত হয় সুপ্রচুর গদ্য। স্মরণের উপলক্ষস্বরূপ উভয়ের জন্ম-প্রয়াণবার্ষিকী তো রয়েছেই। তা ছাড়া বছরভরই এই দুই কবি নানাভাবে শব্দসাম্রাজ্যে বিচিত্র রচনায়, মঞ্চমুখরতায় বিবিধ উপস্থাপনায় এবং ইলেকট্রনিক ধ্বনিচিত্র মাধ্যমে বিশদ নির্মাণশিল্পে বহুমুখিতায় সংবর্ধিত হন। সে বিচারে জীবনানন্দ এখনো অনেকটা উপেক্ষিত।
অনেকেই হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন এই সত্যোচ্চারণে যে রবীন্দ্র-নজরুলকে নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে যত আনুষ্ঠিকতার উচ্ছ্বাস উড়ালপ্রবণ তার সিংহভাগই সংগীতকেন্দ্রিক। গান মননে প্রবেশের আগে মনে ঠাঁই করে নিতে পারে। গানের বাণীর অর্থবৈভব অনেকটা অবোধ্য থেকে গেলেও শুধু সুরের জাদুতেই মানুষ মোহিত হয়ে থাকতে পারে। সুরেলা গলা, আর শোভন-বাচন শ্রোতাকে মোহমুগ্ধ করে রাখতে পারে। রবীন্দ্রসাহিত্য, এমনকি নজরুলসাহিত্যও সত্যিকার অর্থে সঠিকভাবে চর্চা হয়নি এ দেশে। আবৃত্তিকারদের সৌজন্যে কানে পশছে বটে উভয়ের কবিতা, তবে সঠিক ব্যঞ্জনা ও অর্থ নিয়ে নিবেদিত হতে পারছে কিনা তা নিয়ে আমার ঘোর সংশয় বিদ্যমান। জীবনানন্দের কথায় আসি। তাঁর ‘বোধ’ কবিতাটি সেই তিন দশক আগে শুনেছিলাম শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে। প্রতিটি পঙক্তিই যেন স্বচ্ছ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল আবৃত্তিশিল্পীর পরিমিত আবেগে ও অর্থবোধক উচ্চারণে।
সত্যপ্রকাশের দায়বোধ থেকে বলতেই হবে, গোটা ছয়েক অভিজ্ঞ শিক্ষকতুল্য খ্যাতিমান আবৃত্তিকারের কণ্ঠে একই কবিতা শুনে দেখেছি, এদের একজনই কেবল জীবনানন্দের কবিতায় প্রকাশিত অভিব্যক্তিকে যথোচিত মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছেন। কবিতার অর্থ যে বদলে যেতে পারে পঠনে তার প্রমাণ তো আমাদের সামনে ভুরিভুরি। তাহলে কানে শোনার ওপর ভরসা রাখব কী উপায়ে? তাই কবিতার ভাবসম্পদ ও অর্থভুবনের হদিস পেতে হলে নিজের বোধ ও বিবেচনার স্থানটিকেই শাণিত করে তোলা চাই। আর সে জন্য বেশি বেশি করে কবিতার বহুরৈখিক আলোচনা ও মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক।
আমি মনে করি অন্তত আজকের এই দিনটিতে এবং জীবনানন্দের জন্মবার্ষিকীতে আমাদের কর্তব্য হবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তাঁর কবিতার শুদ্ধ পাঠ ও যথোচিত আলোচনার আয়োজন করা। সেই সঙ্গে কবির অজস্র অপঠিত গল্প থেকে নির্বাচন করে প্রতিবছর অন্তত পাঁচটির নাট্যরূপ দিয়ে টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করা। এ পর্যায়ে তাঁর উপন্যাসও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। নব্বইয়ের শেষাংশে ও ২০০০ সালে এ ধারার শুরুটা করতে পারলেও আমার একার পক্ষে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আর সম্ভব হয়নি। তাই আজকের তরুণ-নবীনদের প্রতি সেই আহ্বান জানাই।
পুনশ্চ
অনেক বছর পর এবার বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য জীবনানন্দ স্মরণে পঞ্চাশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করি। অভিজ্ঞতাটি আনন্দদায়ক। কবি, কবিতানুরাগী কিংবা কবিতার পাঠক বা আবৃত্তিকার যেই হোন না কেন, জীবনানন্দের প্রতি সবাই এক আশ্চর্য ভালোবাসা বোধ করে থাকেন- এটির প্রমাণ আবারও পেলাম। তাঁকে প্রাণের কবি বলে ভাবেন। ইচ্ছে ছিল কবির মাল্যবান উপন্যাসের খানিকটা নাট্যরূপ পরিবেশন করা সম্ভব হবে। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতও করেছিলাম, যেখানে মাল্যবান ও উৎপলার মেরুদূর দাম্পত্য সম্পর্কের এক প্রত্যক্ষ প্রকাশ ঘটবে। শেষ পর্যন্ত নাট্যায়ন সম্ভব হয়নি। তবে তৃপ্তি বোধ করেছি অন্তত একটি নতুন বিষয় টিভিতে উপস্থাপন করতে পেরে। সেটি হলো কবিতার নৃত্যরূপ পরিবেশনা।
‘আমি যদি হতাম’ কবিতায় মানব-মানবীর বনহংস-বনহংসী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। নৃত্যভঙ্গিমায় জীবনানন্দকাব্যের আশ্চর্য স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ খুব সহজ নয়। তবু চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। রূপসী বাংলার যে কবিতাগুলোয় স্বদেশপ্রেমের বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে, বিশেষ করে ‘আবার আসিব ফিরে’, কিংবা ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ এগুলোয় সুরারোপ করে বাংলার প্রকৃতির নয়নলোভন দৃশ্য প্রদর্শন- সব মিলিয়ে বাঙালির মনে এক অভিঘাত সৃষ্টিতে সক্ষম। আজ রাত সাড়ে দশটায় প্রচারিত অনুষ্ঠানটি দেখলে পাঠক অনুভব করবেন কবির কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে কত বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হতে পারে। তারপরও একটি কথা না বললেই নয়, এখনো আমরা জীবনানন্দের বড়জোর পনেরটি কবিতাই পাঠ করে থাকি, সেগুলো নিয়ে আবেগ প্রকাশ করি, একই ধরনের আলোচনায় ঘুরপাক খাই।
জীবদ্দশায় জীবনানন্দ যে ১৩৬টি কবিতা গ্রন্থবদ্ধ করে যান, সেসব তো বটেই, তাঁর প্রয়াণের পর যে বিপুল কবিতারাশি আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর ব্যাপক পঠন সম্পন্ন হলে আমরা জীবনানন্দের কবিচারিত্র আরো ভালো অনুধাবনে সক্ষম হব। সে জন্য নিবিষ্ট ও পরিশ্রমী গবেষক-সমালোচকের দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে আছি।