ইউনেস্কোর ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় রিকশা পেইন্টারদের কসমস ফাউন্ডেশনের সংবর্ধনা
ঢাকার রিকশা পেইন্টারদের একটি দলকে সম্মান জানিয়ে ‘গ্যালারি অন হুইলস’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে কসমস ফাউন্ডেশন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বারিধারার ব্যক্তিগত জাদুঘরে কসমস ফাউন্ডেশনের শিল্প শাখা গ্যালারি কসমসে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
চলতি মাসের শুরুতে রিকশা ও রিকশা চিত্রগুলোকে ইউনেস্কো তার ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত লিও টিটো এল আউসান জুনিয়র, কসমস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী এবং কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু, সৈয়দ আহমেদ হোসেন, এস এ নূর আলী, মো. মনির হোসেন ও মোহাম্মদ সোলেমানসহ বিভিন্ন রিকশা চিত্রশিল্পী ও দেশি-বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘ইউনেস্কোর ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি ঐতিহ্যের তালিকায় এই উল্লেখযোগ্য অন্তর্ভুক্তিকে সম্মান জানাতে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য রিকশা চিত্রশিল্পীদের এবং কসমস ফাউন্ডেশনকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এই বছর আমরা ঢাকায় আমাদের ঐতিহ্যবাহী (স্বাধীনতা) কুচকাওয়াজের অংশ হিসেবে 'অ্যাডর্ন-এ-রিকশা'- শিরোনামের একটি অনন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। যা ছিল আমাদের দেশের আইকনিক বাহনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আমাদের সমৃদ্ধি ও ফিলিপিনো উৎসবের রং।’
অনুষ্ঠানটি যে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছে এবং ফিলিপাইনের ‘আতি আতিহান’ উৎসবের মতো বিশ্বব্যাপী ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোর কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত লিও বলেন, এই অর্জন উদযাপনের জন্য বাংলাদেশেরও একটি রিকশা-থিমভিত্তিক বার্ষিক উৎসব হওয়া উচিত।
কসমস ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যখন আমরা বড় হয়েছি, আমরা পেছনে প্রাণবন্ত ও অর্থবহ চিত্রকর্ম সম্বলিত রিকশা দেখেছি– এবং সবসময় উপলব্ধি করেছি যে এই কাজের উল্লেখযোগ্য শৈল্পিক মূল্য রয়েছে। আমি এনায়েতউল্লাহ খান ও কসমসকে অভিনন্দন জানাতে চাই এটি উপলব্ধি করার জন্য এবং আজ রাতে আমাদের সামনে এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য। এই শিল্প আমাদের জীবদ্দশায় বহুদূরে এগিয়ে যাবে। কারণ রিকশা ও রিকশাচিত্র যানবাহনের চেয়ে বেশি, ঢাকা ও এর জনগণের সঙ্গে এর এক ধরনের অনন্য ও চিরায়ত বন্ধন রয়েছে। এটি সেই সম্পর্কের সারমর্ম, যা সহজাতভাবে কখনই ফিকে হওয়ার নয়, ইউনেস্কো একেই স্বীকৃতি দিয়েছে এবং আমরা আজ এখানে তা উদযাপন করছি।’
অনুষ্ঠানে এনায়েতউল্লাহ খান এই অর্জনের প্রশংসা করে বলেন, ‘ডিসেম্বর আমাদের জন্য বিজয়ের মাস এবং এই বছর আমরা আরেকটি বিজয় অর্জন করেছি; কারণ ইউনেস্কো আমাদের রিকশা চিত্রকর্মকে তার ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব জানতে পেরেছে যে শিল্পের এই ধারাটি কতটা সৃজনশীল, প্রাণবন্ত ও রঙিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৩৮ সালের দিকে ঢাকা শহরে প্রথম রিকশা আসে এবং জাপান যখন জ্বালানি সংকটে ছিল তখন প্রথম এই পরিবহন চালু হয়েছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন রিকশায় চড়ে সামনের দিকে তাকালে চলন্ত রিকশার পেছনের চিত্রকর্ম দেখতাম। প্রায়ই আমরা সিনেমার বিজ্ঞাপন বা বিশ্বের আকর্ষণীয় স্থান বা বিভিন্ন প্রাণীর ছবি এবং মনোরম, নৈসর্গিক সৌন্দর্য বা কখনো কখনো জ্ঞানমূলক উদ্ধৃতি দেখতাম!’
সারাবিশ্বে রিকশা পেইন্টিং প্রচারের বিস্তৃত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে খান বলেন, ‘আমি বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশে ভ্রমণ করেছি, কিন্তু আমি কখনো আমাদের মতো সৃজনশীল জাতি দেখিনি। আজ, আমরা আমাদের থাকার জায়গা, বাথরুম ইত্যাদিতে অসংখ্য রিকশা পেইন্টিং মোটিফ দেখতে পাই। আমরা চাই বিশ্বের সবাই আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানুক।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাই, আমরা জাতির অর্জন বাড়াতে সাহায্য করার জন্য একটি বার্ষিক রিকশা পেইন্টিং উৎসবের আয়োজন করতে চাই। এজন্য আমরা আমাদের কসমস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ব্যাপক গবেষণা করব। আমরা ভবিষ্যতে রিকশা পেইন্টিংয়ের উপর বই, ছোট ডকুমেন্টারি এবং অন্যান্য সৃজনশীল কাজের প্রকাশনার মাধ্যমে ফলাফলগুলোকে উপস্থাপন করতে চাই। আমাদের কসমস ফাউন্ডেশন এবং গ্যালারি কসমসের মতো শিল্পকলা শাখার মাধ্যমে আমরা সবসময় এভাবেই বাংলাদেশের প্রচার করি।’
শিল্পীরা তাদের বেশ কিছু রিকশা পেইন্টিং, পোস্টার ও রিকশা পেইন্টিং-থিমযুক্ত পণ্য প্রদর্শন করেন। তারা তাদের মহিমান্বিত ও প্রাণবন্ত শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপনার মাধ্যমে অতিথিদের বিমোহিত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা (রিকশা পেইন্টার) এই শিল্পে তারকাদের চেয়ে কম ছিলাম না, তখন প্রতিটি ছবির পোস্টারকে রিকশা পেইন্টের মোটিফ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা হতো। ডিজিটাল মিডিয়ার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের গতি হারাতে শুরু করেছি। একটা সময় ছিল যখন মানুষ আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করত, কারণ আমরা বিভিন্ন সাজসজ্জার মাধ্যমে এই শিল্পের প্রচার শুরু করেছিলাম।’
প্রধান শিল্পী মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু অনুষ্ঠানটি আয়োজনের জন্য কসমস ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘মজার বিষয় হলো ডিজিটাল মিডিয়া এবং ডিভাইসগুলোর কারণে যদিও আমাদের সুযোগ কমেছে, তবে এই সময়েই আমাদের শিল্প সীমানা ছাড়িয়ে গেছে এবং এই ডিজিটাল মাধ্যমের কল্যাণেই ইউনেস্কো থেকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা পেলে আমরা আমাদের রিকশা পেইন্টিংগুলোকে অকল্পনীয় উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।’
বতসোয়ানা প্রজাতন্ত্রের কাসানে ক্রেস্টা মোওয়ানা রিসোর্টে ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বর ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ রক্ষার জন্য আন্তঃসরকারি কমিটির অষ্টাদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে ইউনেস্কো রিকশা ও রিকশা চিত্রগুলোকে ঢাকা, বাংলাদেশের মানবতার ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।