প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ
বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ একজন প্রতিভাবান কবি হিসেবে বিশেষ স্থান অর্জন করে আছেন। মূলত তাঁর কবিতায় প্রেম ও দ্রোহের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে, যা পাঠকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
প্রেম ও দ্রোহের কবি সাংবাদিক হেলাল হাফিজের লেখনীতে প্রেমের গভীরতা ও দ্রোহের তপ্ত লাভাকে একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে যায়। এই কাব্যগ্রন্থে প্রেমের আবেগ যেমন গভীরভাবে ধরা পড়েছে, তেমনি সমাজের প্রতি দ্রোহের তপ্ত লাভাও প্রতিফলিত হয়েছে।
হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ ১৯৮০-এর দশকে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, যেখানে দ্রোহের তপ্ত লাভা বিস্ফোরিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় প্রেমের দিকটি গভীর আবেগময় এবং হৃদয়গ্রাহী। তিনি প্রেমকে দেখেছেন একটি পরিশুদ্ধ ও মুক্ত স্বত্ত্বা হিসেবে, যা ব্যক্তি এবং সামগ্রিকভাবে সমাজকে প্রভাবিত করে। তার কবিতায় প্রেম শাশ্বত এবং সমসাময়িক উভয় রূপেই উপস্থিত।
অন্যদিকে, হেলাল হাফিজের কবিতায় দ্রোহের দিকটি মূলত সমাজের অন্যায়, অবিচার এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ। তাঁর লেখনী ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। তিনি প্রেম ও দ্রোহের কবি হয়ে ওঠেন তাঁর সাহসী এবং সংবেদনশীল লেখনীর মাধ্যমে, যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যেভাবে লেখা হয় ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাখানি
কিভাবে লেখা হয় ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’? আরেক কবি হাসান হাফিজের এমন এক প্রশ্নের জবাবে হেলাল হাফিজ বলেন, “উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান যে কতটা সর্বগ্রাসী ও সর্বপ্লাবী ছিল, সেটা যাঁরা না দেখেছেন, তাঁদের বোঝানো দুষ্কর। তো গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে একদিন সন্ধ্যায় আমি পুরান ঢাকা থেকে ইকবাল হলে (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ফিরছিলাম। তখন আমি বাংলায় অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় আমার রিকশাটি থামল। সেখানে তখন মিছিল চলছে। ইপিআর (এখন বিজিবি) ও পুলিশ মিছিলকারীদের পেটাচ্ছে, ধাওয়া দিচ্ছে। মিছিল থেকেও ছোড়া হচ্ছে ইটপাটকেল। এর মধ্যে বয়স্ক এক রিকশাচালক বলে উঠলেন, ‘মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ রিকশাওয়ালারা মাঝেমধ্যে টুকটাক ইংরেজি শব্দও বলে। কথাটা আমার মগজে ও মনে গেঁথে গেল। আসলেই তো তাই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে। ওই ঘটনা থেকেই কবিতাটির জন্ম।’
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে আসন করে নেন কবি হেলাল হাফিজ। এ কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে দেওয়া তারিখ অনুযায়ী কবিতাগুলো লেখা হয় ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।
প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ পাঠকমনে যে নাড়া দিয়েছেন, তা এখনও ইতিহাস হয়ে আছে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটির এখন পর্যন্ত ৩০টিরও অধিক সংস্করণ হয়েছে। যা বাংলাদেশের আর কোনো কাব্যগ্রন্থের বেলায় ঘটেনি।
এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি হেলাল হাফিজ। ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।
এত কম কবিতা লিখে এত বেশি খ্যাতি পাওয়ার নজির বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে আর নেই।
হেলাল হাফিজ ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক ‘পূর্বদেশে’ সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
কবিতায় অসামান্য অবদানের স্মারক হিসেবে হেলাল হাফিজকে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা।