অযত্ন-অবহেলায় ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ
অযত্ন আর অবহেলায় ময়মনসিংহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। নিম্নমানের কাজের ফলে ভেঙে নিচে খসে পড়ছে প্যানেলের খণ্ডিত অংশ। গবাদি পশুর অবাধ বিচরণ, পশুপাখির বিষ্ঠা আর মানুষের মলমূত্র ত্যাগের ফলে বাতাসে ভেসে আসা উৎকট দুর্গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। বসে নেশাখোর ও জুয়াড়িদের আড্ডাও। ফলে বাঙালির আবেগের এই স্থানটির পবিত্রতা রক্ষা এবং পরিচ্ছন্নতা দেখার যেন কেউ নেই।
জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, প্রশাসনের চরম অবহেলার ফলে স্মৃতিসৌধটি আজ পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। এই স্মৃতিসৌধের প্রতি জেলা প্রশাসনের কোনো দৃষ্টি নেই। আমরা এর নিন্দা জানাই।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউসুফ খান পাঠান বলেন, ‘এটার দেখভাল কে করে, তা জেলা প্রশাসন ভালো বলতে পারবে। আগে আমরা দেখভাল করতাম। আমরা উইথড্র হয়ে এসেছি।’
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে ময়মনসিংহের অনেক যোদ্ধা শহীদ হন। সেই শহীদদের স্মরণে ১৯৯৯ সালে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন শহরের পাটগুদাম এলাকায় নির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। সে সময় এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় অর্ধকোটির বেশি (৫৫ লাখ ৩১ হাজার ৯২৪) টাকা। স্মৃতিসৌধে স্থাপিত ৫০ ফুট স্তম্ভের অগ্রভাগে শাপলার ওপর জাতীয় পতাকা। রয়েছে ২৬টি রাইফেলে উন্মুক্ত বেয়নেটের উপর ফুটন্ত শাপলা। শাপলার নিচেই রয়েছে ৭১ সাল স্মরণে ৭১টি ত্রিকোণ আকৃতির প্যানেল। কিন্তু ১৭ কোটি বাঙালির আবেগ ও সম্মানের এই স্মৃতিসৌধটি আজ পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। এমনকি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে স্মৃতিসৌধের ৭১টি প্যানেলের অংশগুলো। এসব নিচে পড়ে জমা হয়েছে সুড়কি, পাথরের স্তূপ।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে স্মৃতিসৌধ এলাকাসহ মূলবেদী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হলেও সারা বছরই স্মৃতিসৌধটির খোঁজ নেন না কেউ। যে কারণে স্মৃতিসৌধে যে কেউ জুতা নিয়ে উঠছে, কেউ বসে নেশা করে আবার অনেকেই মেতে ওঠে আড্ডাবাজিতে। এতে স্মৃতিসৌধের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য এবং পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হচ্ছে।
স্মৃতিসৌদের মূল বেদীর চারদিকের চারটি দেয়ালের চার রকমের প্রাচীরচিত্রের সৌন্দর্যও নষ্ট হওয়ার পথে। নির্মাণের সময় স্মৃতিস্তম্ভটিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিমূর্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সর্বসাধারণের অবাধ বিচরণে নষ্টের পথে আজ সবই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেশের সূর্য সন্তানদের স্মরণে এই স্মৃতিসৌধ এলাকায় গরু-ছাগলের অবাধ বিচরণ রয়েছে। এসব পশুর মলত্যাগে নোংরা থাকে পুরো স্মৃতিসৌধ এলাকা। স্মৃতিসৌধ এলাকার আশপাশের রাস্তাগুলোর সংস্কার না হওয়ায় স্মৃতিসৌধের ভেতর দিয়ে অবাধে চলাচল করছে জনসাধারণ। এমনকি চলাচলের সুবিধার জন্য স্মৃতিসৌধের দেয়াল ভেঙে করা হয়েছে যাতায়াতের রাস্তা। স্মৃতিসৌধটি খোলামেলা থাকায় জনসমাগম থাকে সবসময়ই। নিয়মিত স্মৃতিসৌধটি পরিষ্কার না করায় পশুপাখি এবং মানুষের মলত্যাগের দুর্গন্ধ সব সময় বাতাসে ভাসতে থাকে। স্তম্ভটির উপরের অংশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিচে পড়ে জমা হয়েছে সুড়কি, পাথরের স্তূপ।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর আসন থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহামেদ বলেছেন, ‘জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ছিল। দুই বছর ধরে এটাতে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ কেউ উদ্যোগ নেয় না। নেগলেজেন্সি শুধু দেখি। আর স্পেসিফিক্যালি এটার প্রতি তাদের আস্থাও বুঝি নাই, তাই অর্থ খরচ হবে বলেও তারা এটার প্রতি নজর দেয় না। এটার আমরা নিন্দা জানাই, পরিত্যক্ত অবস্থায় স্মৃতিসৌধটি ফেলে রাখার জন্য। স্মৃতিসৌধটা এভাবে আজকে অবহেলিত, তার জন্য আমরা এই প্রশাসনকে; তাদের আচরণকে অনমনীয় বলি।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠান বলেন, ‘এটা জেলা প্রশাসন বলতে পারবে কে দেখভাল করেন এটা। আমরা জানতাম জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে। আমরা জেলা পরিষদ থেকে দুটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিলাম ওখানে জেলা পরিষদ শিশুপার্ক হবে। আমাদের না জানিয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে অফিস করার জন্য দেওয়া হয়েছে। আমাদের একটা কেয়ারটেকার ছিল। এখন এখানে আমাদের কিছুই করার নাই। আমরা তাকে অন্য ডিউটি দিয়েছি।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
নির্মাণের সময় স্মৃতিস্তম্ভটিতে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিমূর্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সর্বসাধারণের অবাধ বিচরণে নষ্টের পথে স্থাপনাগুলো।
বাঙালির আবেগের স্থান এই ক্ষতিগ্রস্ত স্তম্ভটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার করা হবে-এই দাবি এখন ময়মনসিংহের সচেতন মহলের।