অর্থপাচার মামলার আসামি জামিন পেলেন ভুল তথ্যে!
ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারকারী চক্রের সাথে যুক্ত এক আসামিকে জামিন দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। সম্প্রতি একই মামলার অপর এক আসামি হাইকোর্টে জামিন নিতে গেলে অ্যাটর্নি অফিসের নজরে আসে। হাইকোর্ট অর্থপাচারের অভিযোগে আসামিকে জামিন না দিয়ে ফেরত দেয়।
এনটিভি অনলাইনের অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে ডলারের দাম বাড়ানোসহ নানা কারণ নিয়ে গত বছরের শেষে তদন্ত শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ সময় বড় একটি চক্রকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে গত এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। হুন্ডি কারবার করা এমন ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সিআইডি অনুসন্ধানে জানায়, গ্রেপ্তারকৃত সংঘবদ্ধ চক্র প্রবাসে বাংলাদেশিদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা দেশে না পাঠিয়ে এর সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। এ কাজে অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে থাকে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে, দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপ পাচারকারী ও তার সহযোগীরা দেশীয় মুদ্রায় এই অর্থ এমএফএস এজেন্টকে দেয়। তৃতীয় গ্রুপ তথা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর কাছ থেকে পাওয়া এমএফএস নম্বরে দেশীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে। এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে।
তারা মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল হুন্ডি কারবার করত। এ ঘটনায় ৪টি মামলা দায়ের করে সিআইডি। তার মধ্যে একটি মামলার বিবরণে দেখা যায়, রাজধানীতে রাব্বি টেলিকম এজেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান এমএফএস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অস্বাভাবিক লেনদেন করছে।
মামলার নথিতে দেখা যায়, শামীমা আক্তার টিএমআই ইন্টারন্যাশনাল নামীয় কোম্পানিতে চাকরি করেন। যার মালিক ইতালি প্রবাসী মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমান ইতালিতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রবাসীর মোবাইলফোন নম্বর সরবরাহ করে। শামীমা সে সব নম্বরে ফোন করে প্রবাসীদের বলতেন তাদের কোম্পানি ইতালির সিম বিক্রি, সিম একটিভিশন, এয়ার টিকেট বিক্রি ইত্যাদি সেবা দিয়ে থাকে। তিনি কোম্পানির বিকাশ রকেট সেবাও দেখতেন। তার কোম্পানির ক্লায়েন্টরা টিএমআই অ্যাপসের মাধ্যমে এসব সুবিধা নিত। কিন্তু মূল ব্যবসা হচ্ছে অ্যাপসের মাধ্যমে প্রবাসীরা ইতালিয়ান মুদ্রা বিভিন্ন ইতালিয়ান ব্যাংকে জমা প্রদান করতেন; যা বিকাশ রকেট হয়ে পৌছে যেত তাদের বাংলাদেশের স্বজনদের কাছে, অর্থাৎ অ্যাপসের মাধ্যমে অবৈধ হুন্ডি। যাদের এরকম বহু বিকাশ ও রকেট এজেন্ট ছিল।
রাব্বী টেলিকম এরকম একটি প্রতিষ্ঠান যে, ১ এপ্রিল ২০২২ থেকে ৩১ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত মাত্র চার মাসে একটি নম্বর থেকে ৯ হাজার ৮৮৮টি ট্রান্সজেকশনের মাধ্যমে সর্বমোট ৬ কোটি ৫৬ লাখ ৩১ হাজার তিনশত নয় টাকা ক্যাশ ইন করে। যার অধিকাংশই প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আত্মীয় স্বজনদের বিকাশ হিসেবে ক্যাশ ইন করা হয়।
সিআইডির মামলার নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, শামীমা ১ এপ্রিল ২০২১ এ কোম্পানিতে যোগদান করেন আর গ্রেপ্তার হন ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। কেবল একটি বিকাশ নম্বরে চার মাসে সাড়ে ৬ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন হয়। তাহলে শামীমার ১৭ মাস চাকরির সময়ে গড়ে প্রতি মাসে দেড় কোটি অর্থাৎ প্রায় ৩০ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এভাবে কত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়েছে কিংবা তার আগেও টিএমআই কোম্পানি এভাবে কত টাকা হুন্ডি করেছে তার অংক তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত জানা সম্ভব নয়। তবে বিরাট অংকের হবে তা নিশ্চিত অনুমেয়। এ ঘটনায় গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বাদি হয়ে মামলা করেন সিআইডি। এ মামলায় ফজলে রাব্বি, শামীমা আক্তার, মিজানুর রহমান এবং অপর কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা পরষ্পর যোগসাজশে বিদেশে থাকা আসামিদের সহায়তায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিকট থেকে অ্যাপসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশে না পাঠিয়ে আসামিদের মাধ্যমে সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় বাংলাদেশে অবস্থিত রাব্বি টেলিকমসহ আরও বিকাশ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসীদের আত্মীয় স্বজনের বিকাশ নম্বরে ক্যাশ-ইন করে মানিলন্ডারিং করেছে।
এনটিভির অনুসন্ধানে জানা যায়, অর্থ পাচারকারি চক্রের অন্যতম সদস্য শামীমা আক্তারকে গত ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ৮ম অতিরিক্ত আদালতের বিচারক সৈয়দা হাফছা জুমা জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিন আদেশে আদালত বলেন, ‘নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দরখাস্তকারী আসামির বিরুদ্ধে ২০১২ সালের (সংশোধনী/১৫) এ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)/৪(৪) ধারার অভিযোগ আনয়ন করা হয়েছে। এজাহার পর্যালোচনায় দেখা যায়, দরখাস্তকারী আসামি বিকাশে চাকরি করতেন। বিগত ৭/৯/২০২২ তারিখ গ্রেপ্তার হয়ে অদ্য পর্যন্ত জেল হাজতে আছেন। মামলাটি তদন্তাধীন, তদন্তে এখনো অগ্রগতি নেই এবং দীর্ঘ হাজতবাস বিবেচনায় বিজ্ঞ কৌশলী ও একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির জিম্মায় জামিন মঞ্জুর করা হলো।’
অথচ মামলার এজাহারে দেখা যায়, ‘আসামি বিকাশে চাকরি করতো না বরং আসামি মূল পাচারকারী টিএমএই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিল। এ প্রতিষ্ঠান কেবল একটি বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে চার মাসে সাড়ে ৬ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে।’
নিম্ন আদালতের আদেশে তাকে বিকাশে চাকরি করত মর্মে ভুল তথ্য সন্নিবেশিত করে জামিন দেওয়ার ঘটনায় হাইকোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে বাংলাদেশে তার থেকেও অনেক বেশি আসতো যদি এরুপ হুন্ডি বন্ধ করা যেত। আর সে লক্ষ্য সামনে রেখেই মনিটরিং এখন আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এ মামলা। ডিজিটাল অ্যাপসের মাধ্যমে অভিনব উপায়ে অবৈধ লেনদেন করলেও যে সরকারের নজরদারির বাইরে কেউ নয়, তা এ মামলায় বোঝা যায়। কিছুদিন আগে এ মামলার এক আসামি নিম্ন আদালতে ব্যর্থ হয়ে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। আমি যে কোর্টে দায়িত্বরত ডিএজি অর্থাৎ বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লা এবং বিচারপতি খোন্দকার দীলিরুজ্জামানের এর হাইকোর্ট বেঞ্চ তাকে জামিন না দিয়ে আবেদন ফেরৎ দেয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মামলার অন্যতম আসামি শামীমা আক্তার নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। বিজ্ঞ আদালত কোনো মামলায় জামিন দিতেই পারেন, এটা তার বিচারিক ক্ষমতা। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তিনি আদেশে ভুল তথ্য সন্নিবেশিত করেছেন যা প্রত্যাশিত নয়।’