অ্যাপ দিয়ে সুদের ব্যবসা, হুমকিতে গ্রাহকের তথ্য নিরাপত্তা
অ্যাপসভিত্তিক ডিজিটাল মাইক্রোফাইন্যান্সের নামে অবৈধ সুদের ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গত মঙ্গলবার ও বুধবারের ধারাবাহিক অভিযানে তাদের রাজধানীর ধানমণ্ডি, বনানী ও মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ইমানুয়্যাল এডওয়ার্ড গোমেজ, আরিফুজ্জামান, শাহিনূর আলম ওরফে রাজীব, শুভ গোমেজ ও মো. আকরাম। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি অ্যাশ রংয়ের এলিয়ন গাড়ি, নয়টি মুঠোফোন, নয়টি সিম কার্ড, চারটি ল্যাপটপ ও চারটি বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই উদ্ধার করা হয়।
এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতরা সরকারি অনুমোদন ছাড়া থান্ডার লাইট টেকনোলজি লিমিটেড, নিউ ভিশন ফিনটেক লিমিটেড ও বেসিক ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। আইনগত অনুমোদন ছাড়া তারা গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করে।’
‘শুধু তাই নয়, উক্ত অ্যাপস ইন্সটল করার মাধ্যমে গ্রাহকের অজান্তে ক্যালেন্ডারের ইভেন্ট পড়া, গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া দূর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মোবাইল ক্যামেরা ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিও ধারণ, মোবাইলের কন্টাক্টস পড়াসহ মোবাইলের এক্সাক্ট লাইভ লোকেশন নির্ণয়, ফোনের স্ট্যাটাস এবং তথ্য সংগ্রহ, ফোনে সংরক্ষিত মেসেজ পড়া, পরিবর্তন করার অনুমতি নিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের পারসোনাল ডাটা সিকিউরিটির চরম হুমকিতে পড়ে।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা অনলাইন অ্যাপস যেমন; সুদ কারবারের অ্যাপগুলোর মধ্যে রয়েছে- টাকাওয়ালা (পার্সোনাল লোনস অনলাইন), র্যাপিডক্যাশ, আমার ক্যাশ, ক্যাশ ক্যাশসহ আরও অনেক অ্যাপ। এসব অ্যাপ প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ মানুষ ডাউনলোড করেছে। সবাই ব্যবহার না করলেও বিশাল একটা অংশ এসব অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে।’
‘এর মাধ্যমে জামানতবিহীন লোন দেওয়ার নামে চলে মাত্রাতিরিক্ত সুদের কারবার। এসব অ্যাপসগুলোর সার্ভার চায়নাতে অবস্থিত এবং যেগুলো মূলত চায়না থেকে পরিচালিত হয়। কিছু চাইনিজ নাগরিক বাংলাদেশি নাগরিকের সহায়তায় বর্ণিত অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে জামানতবিহীন স্বল্প সুদে লোন প্রদান করার নামে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহক আকৃষ্ট করে। তাদের বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে গ্রাহকরা লোন গ্রহণ করার পর স্বল্প সুদের পরিবর্তে উচ্চহারে সুদ প্রদানের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে। প্রতারণার শিকার এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধানমণ্ডি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়। এ মামলা তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।’
এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা এসব অ্যাপগুলো ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বল্প সুদে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। তারা মূলত অর্থ সংকটে থাকা স্বল্প আয়ের লোকজন এবং বেকার ছাত্র-ছাত্রীদের টার্গেট করে। টার্গেটকৃত গ্রাহকরা বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত লিংকে ক্লিক করে কিংবা গুগল স্টোর থেকে উক্ত অ্যাপসগুলো ডাউনলোড করে। চাহিদামতো বিষয়ে অনুমতি দিলে অ্যাপসটি গ্রাহকের মোবাইলে ইন্সটল হয়ে যায়। এরপর গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন নাম্বার, পরিবারের অন্য সদস্যদের ফোন নম্বর ও তাদের ব্যক্তিগত তথ্যসহ অন্যান্য তথ্য দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্রাতিরিক্ত প্রসেসিং ফি নিয়ে এবং উচ্চ হারে সুদ নির্ধারণ করে স্বল্প সময়ের জন্য তিন থেকে সাত দিনের জন্য ঋণ প্রদান করে। গ্রাহক তিন হাজার টাকার জন্য আবেদন করলে অনুমোদনের পর প্রসেসিং ফি বাবদ ৮১০ টাকা রেখে গ্রাহককে মাত্র দুই হাজার ১৯০ টাকা দেওয়া হয়। সাত দিন শেষে গ্রাহককে পরিশোধ করতে হয় মোট তিন হাজার ১৮ টাকা। মেয়াদ শেষে অনাদায়ে প্রতিদিন হিসাবে গ্রাহককে উচ্চহারে সুদ দিতে হয়। এ ছাড়া অ্যাপ্লিকেশন ফি বাবদ ১২০ টাকা, ডাটা অ্যানালাইসিস ফি ১৮০ টাকা, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১৫ টাকা এবং সুদ বাবদ পাঁচ টাকা কেটে রাখার যুক্তি দেখায়। তবে, পরিমাণ যতো বেশি হবে টাকা কেটে রাখার প্রবণতাও বেশি। এ ঋণের টাকা গ্রাহককে বিকাশ অথবা নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। প্রতারকদের এ লোভনীয় অফারের ফাঁদে পড়ে অনেকে সর্বস্ব হারায়।’