আত্মহত্যার আগে আনিসকে টাকা পরিশোধের কথা ছিল : র্যাব
নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করেছেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ব্যবসায়ী গাজী আনিসুর রহমান। আত্মহত্যার প্ররোচনার ঘটনায় একটি মামলা করা হয়। ওই মামলার গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরা থেকে আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন ও পরিচালক ফাতেমা আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাবের দাবি, নুরুল আমিন ও ফাতেমা আমিনের কাছে প্রায় তিন কোটি টাকা পান আনিস। দফায় দফায় চেষ্টা করে টাকা উদ্ধার করতে পারেননি আনিস। ফলে, রাগে, ক্ষোভে ও অভিমানে তিনি শরীরে পেট্রোল জাতীয় দাহ্য পদার্থ ঢেলে আত্মহত্যা করেন।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মর্মান্তিক এ ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করা হয়। এরপর র্যাব বিষয়টির তদন্তে নামে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মামলার এজাহারভুক্ত অভিযুক্ত নুরুল আমিন (৫৫) ও ফাতেমা আমিনকে (৪৫) গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার এজাহার, ভুক্তভোগীর পরিবার ও অন্যান্য সূত্রের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন দাবি করেন, ‘২০১৭ সালে আমিন গ্রুপের কর্ণধার নুরুল আমিন এবং তাঁর স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে গাজী আনিসের পরিচয় হয়। এরপর সখ্য গড়ে ওঠে। গ্রেপ্তার হওয়া দুই ব্যক্তি ২০১৮ সালে চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যান। সেখানে স্থানীয় একটি আবাসিক হোটেলে একইসঙ্গে অবস্থানকালে অভিযুক্তরা ভুক্তভোগীকে হেনোলাক্স কোম্পানিতে বিনিয়োগের জন্য প্ররোচিত করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আনিস প্রথমে অসম্মতি জানালেও পরবর্তীতে রাজি হন এবং প্রাথমিকভাবে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে তাঁদের প্ররোচণায় তিনি আরও ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। অধিকাংশ টাকা আনিস ঋণ হিসেবে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান ও বিশ্বাসের কারণে তাঁদের মধ্যে কোনো চুক্তিনামা করা হয়নি।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য গাজী আনিস বারবার অভিযুক্তদের অনুরোধ করেন। কিন্তু, তাঁরা গড়িমসি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে আনিসকে অভিযুক্তরা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করতেন সেটাও বন্ধ করে দেন। কয়েকবার তাঁরা লোকজন দিয়ে আনিসকে হেনস্তা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন চেষ্টা করেন।’
বর্তমানে লভ্যাংশসহ আনিসের ন্যায্য পাওনা তিন কোটি টাকার অধিক বলে জানিয়েছে র্যাব। সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, ওই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ভিকটিম আসামিদ্বয়ের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার আদালতে দুটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া ওই টাকা ফিরে পাওয়ার জন্য চলতি বছরের ২৯ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন আনিস। ৩১ মে আনিস তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে পাওনা টাকা আদায় সংক্রান্ত মামলা দায়েরের বিষয়টি পোস্ট করেন এবং বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্খীদের কাছে সহায়তা চান।
খন্দকার আল মঈন আরও জানান, ঘটনার দিন গাজী আনিসকে পাওনা টাকা পরিশোধের কথা ছিল অভিযুক্তদের। কিন্তু আনিস অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে টাকা দেননি। একদিকে আনিসের কাছে লোকজন টাকা পাবে, অপরদিকে তিনি টাকা আদায় করতে পারছেন না। ফলে, হতাশ হয়ে রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
র্যাব জানায়, গাজী আনিস কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ঠিকাদারী ব্যবসার পাশাপাশি একটি টেলিকম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে কুষ্টিয়ায় গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। তিনি সাহিত্য চর্চাও করতেন এবং তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়া নুরুল আমিন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় কাদের হোমিও হল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছর চাকরি করেন। সে সময়ে তাঁর একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় এলে ১৯৯১ সালে হেনোলাক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি নামে নামকরণ করেন। ওই কোম্পানির অধীনে হেনোলাক্স কসমেটিকস, যেমন- হেনোলাক্স কমপ্লেকশান ক্রিম, হেনোলাক্স স্পট ক্রিম, হেনোলাক্স মেছতা আউট ক্রিম ও হেনোলাক্স হেয়ার অয়েল ও পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবসা করেন। পরবর্তীতে বাজারে হেনোলাক্সের চাহিদা কমে গেলে ২০০৯ সালে তিনি আমিন হারবাল কোম্পানি নামে আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন এবং ২০১৬ সালে হেনোলাক্সের ব্যবসা বন্ধ করে দেন বলে র্যাব জানিয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাকরাইলে একটি ফ্ল্যাট, পুরানা পল্টনে স্কাই ভিউ হেনোলাক্স সেন্টার নামে একটি ১০তলা ভবন, পিংক সিটিতে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, মেরাজনগর কদমতলীতে হেনোলাক্স নামে চারতলা ভবন, মোহাম্মদবাগ কদমতলী এলাকায় হেনোলাক্স ফ্যাক্টরি রয়েছে। বর্তমানে ওই ফ্যাক্টরিতে খান ফুড প্রোডাক্টস, বন্যা ফুড প্রোডাক্টস ও জে কে এগ্রো ফুড নামে তিনটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় তাদের উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।’
গ্রেপ্তার হওয়া ফাতেমা আমিন একটি বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে ডিএইচএমএস সম্পন্ন করে তাঁর স্বামীর আমিন হোমিও হলে প্রথমে এক বছর হোমিও চিকিৎসা করেন। তিনি তাঁর স্বামীর প্রতিষ্ঠিত আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি স্বামীর আমিন হারবাল কোম্পানির দেখাশোনা করেন।