আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাই : সীমান্তে বাড়তি সতর্কতা
রাজধানীর আদালত চত্বরে পুলিশের চোখে স্প্রে করে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের সহযোগীরা। গতকাল রোববার মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। অপরদিকে বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।
ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিরা জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি। তারা যেন কোনোভাবে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে জন্য সীমান্তে বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রেড অ্যালার্ট জারির নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তে সতর্কতা বাড়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদশ (বিজিবি), ইমিগ্রেশন ও পোর্ট থানা পুলিশ। সারা দেশ থেকে এনটিভি প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন :
দিনাজপুরের হিলি থেকে জাহিদুল ইসলাম জানান, হিলি সীমান্ত ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। দুই জঙ্গি পালিয়ে যাওয়ায় বিজিবি এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এই বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
হিলি ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান (২৪) ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবকে (৩৪) তাদের সহযোগীরা গতকাল পুলিশের চোখে স্প্রে ছিটিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারা যাতে কোনোভাবেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য হিলি সীমান্ত ও হিলি চেকপোস্টে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।
জঙ্গি মইনুল হাসান সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে। আর অপর জঙ্গি আবু সিদ্দিক লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেটশ্বর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে।
হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘গতকাল বিকেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। তারা যেন কোনোভাবেই এই পথ দিয়ে ভারতে যেতে না পারে এ বিষয়ে আমরা কঠোর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। ইতোমধ্যেই ওই নামগুলো ব্লক করে দিয়েছি। ওই নামে কোনো ব্যক্তি এই পথ দিয়ে যেতে চাইলেই সে ধরা পড়বে।
এদিকে জয়পুরহাট ২০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এ সংক্রান্ত একটি স্পেশাল নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। সেই মোতাবেক আমরা সীমান্তে কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়েছি। ইতোমধ্যেই সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত আমার অধীনস্থ সব বিওপি সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। একইভাবে হিলি আইসিপি চেকপোস্টে সতর্ক থাকতে বলেছি। সেইসঙ্গে সীমান্তে বিজিবির পক্ষ থেকে টহল বাড়ানো হয়েছে। যাতে শুধু ওই দুজন ব্যক্তি কেন অন্য কোনো ব্যক্তিই যেন কোনোভাবেই অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে।
বেনাপোল থেকে মহসিন মিলন জানান, ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ও যশোর সীমান্তে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে।
বেনাপোল চেকপোস্ট ও সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে জঙ্গিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবি ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ও যশোর সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত টহলের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থা জারি করা হয়েছে। যারা ভারত যাচ্ছে তাদের সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ইমিগ্রেশন ডেস্কে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা প্রতিটি পাসপোর্ট সতর্কতার সঙ্গে দেখে ভারতে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। সন্দেহভাজন লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি কামাল ভূঁইয়া বলেন, ‘দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় দেশব্যাপী রেড অ্যালার্ট জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নির্দেশ আসার পর পরই ইমিগ্রেশন এলাকায় ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি সাদা পোশাকে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
যশোর-৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী বলেন, ‘দুই জঙ্গির ছবি দিয়ে সীমান্তের প্রত্যেক বিওপিকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সীমান্তের অবৈধ পথ দিয়ে যাতে তারা পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন ও টহল জোরদার করা হয়েছে।’
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি পাসপোর্ট নিয়ে যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য ইমিগ্রেশন পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। যারা ভারতে যাচ্ছে তাদের পর্যবেক্ষণ করে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ইমিগ্রেশনের বহির্গমন ডেস্কে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা প্রত্যেক পাসপোর্ট যাচাই-বাছাই করে ভারতে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। সন্দেহভাজন লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে শিহাব উদ্দিন বিপু জানান, আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত এলাকাজুড়ে সতর্ক রয়েছে পুলিশ ও বিজিবি। ইতোমধ্যে আখাউড়া স্থলবন্দর পুলিশ ইমিগ্রেশন কক্ষে পালিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধঘোষিত জেএমবি সদস্য মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেলের ছবি সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিটি বিওপিকে (সীমান্ত পোস্ট) সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি যাতে কোনোভাবেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে না যেতে পারে, সেজন্য গতকাল বিকেল থেকেই বাড়তি সতর্ক অবস্থান নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আখাউড়া স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মোর্শেদুল আলম বলেন, ওই দুই জঙ্গির ছবি ও ঠিকানা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ব্ল্যাক লিস্টেড করে তাদের ছবি ইমিগ্রেশন কক্ষে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। বিধি মোতাবেক সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজিবি ৬০ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক হাসান উল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে নির্দেশনা আসার পর প্রতিটি বিওপিকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে।’
নেত্রকোনা থেকে ভজন দাস জানান, ঢাকার আদালত এলাকা থেকে জঙ্গি পালানোর ঘটনায় ভারতের মেঘালয় সীমান্তের কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর থানা এলাকায় চেকপোস্ট ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আহাদ জানান, গতকাল থেকেই কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্ত সড়কে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও যানবাহনে তল্লাশি চলছে, তা অব্যাহত থাকবে।
দুর্গাপুর থানার ওসি মো. শিবিরুল ইসলাম বলেন, ‘সারা দেশে রেডএলার্ট জারির পর পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদের নির্দেশনায় সীমান্ত এলাকায় বিজিবির পাশাপাশি আমরাও সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
এ বিষয়ে নেত্রকোনা-৩১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এ এস এম জাকারিয়া বলেন, ঢাকার ঘটনার পর সীমান্তের সব এলাকা কঠোর নজরদারিতে রয়েছে। তৎপর রয়েছে বিজিবিও, যাতে কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে।
জামালপুর থেকে আসমাউল আসিফ জানান, জেলার বকশীগঞ্জে কামালপুর স্থলবন্দরসহ জেলার ভারতীয় সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। গতকাল ঢাকার আদালত চত্বর থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিজিবি এই রেড অ্যালার্ট জারি করে।
জামালপুর ৩৫ বিজিবির সহকারী পরিচালক শামসুল হক জানান, সারা দেশের সীমান্তের মতো জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ভারতীয় সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি রয়েছে। বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর স্থলবন্দর দিয়ে শুধু পণ্য পরিবহণ করা হয়, কোনো মানুষ পারাপার হয় না, তবুও সেখানে বাড়তি নজরদারি ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন বিজিবির সদস্যরা। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকাজুড়ে টহল ও গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে কেউ ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাকে আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তরের জন্য বিএসএফকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।
বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তরিকুল ইসলাম জানান, সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় ও স্থলবন্দর থাকায় পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।