আলোচিত সিনহা হত্যা মামলার রায় আজ
বহুল আলোচিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় আজ। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন আজ সোমবার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হন মেধাবী সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা। এ ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে নানা অপচেষ্টা চালানো হলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের নাম এবং তাদের নৃশংসতার কাহিনি।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। অন্যদিকে, বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বাদীপক্ষ।’ তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
এ মামলায় অভিযুক্ত ১৫ আসামি হলেন—টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী (৩১), টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮), বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত (৩০), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩), আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। আসামিদের সবাই কারাগারে আটক রয়েছেন।
মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৬৫ জন ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দেন।
কে এই সিনহা মো. রাশেদ?
মামলার অভিযোগপত্র ও পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, সিনহা মো. রাশেদ খানের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পূর্ব ইউনিয়নের মানিকরাজ গ্রামে। তাঁর বাবা এরশাদ খান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সর্বশেষ তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সিনহা ছিলেন মেজো।
অভিযোগপত্রের ১২ নম্বর পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে জন্মগ্রহণ করেন সিনহা মো. রাশেদ খান। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় পড়াশোনা করতে হয়েছে তাঁকে। পরে ১৯৯৯ সালে রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ২০০১ সালে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। ২০০৩ সালের ২১ জানুয়ারি ৫১তম বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন সিনহা। ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশনপ্রাপ্ত হন তিনি।
মেধাবী এ সেনা কর্মকর্তার শিক্ষাজীবন ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ ২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণিতে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। চাকরিজীবনে তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীন যোদ্ধা (আন্ত-ইউনিট সঙ্গীন যুদ্ধ প্রতিযোগিতা ২০০৭), আন্ত-ইউনিট বেয়নেট ফাইটিং প্রতিযোগিতা ২০০৭-এর শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগী ছিলেন। তিনি ক্যাপ্টেন পদে ২০০৯ সালে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেস প্রটেকশন কোর্স-৫০ সম্পন্ন করেন। ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ১৩ মে পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ‘ভিআইপি প্রটেকশন কোর্স’ সম্পন্ন করেন।
সিনহা মো. রাশেদ খান ২০০৯ সালের ৪ জুলাই থেকে ২০১২ সালের ২ নভেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্য হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আইভোরি কোস্টে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিক্স (এসআইঅ্যান্ডটি) থেকে বিপিসি-১৯ কোর্স শেষ করেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার, সাভার থেকে ‘সিভিল-মিলিটারি রিলেশন অ্যান্ড গুড গভর্ন্যান্স সার্টিফিকেট’ অর্জন করেন। ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে ‘ওয়ার্কশপ অব ডিজাস্টার অ্যান্ড হিউম্যান সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট’ সার্টিফিকেট অর্জন করেন। পরবর্তীকালে ২০১৬ সালে ডিএসসিএসসি থেকে ‘মাস্টার অব সায়েন্স ইন মিলিটারি স্টাডি’ এবং ১২ এপ্রিল ২০১৫ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সাল (২০১৫-২০১৬) পর্যন্ত ‘পিএসসি’ কোর্স সফলতার সঙ্গে শেষ করেন। ২০১৯ সালে তিনি মেজর পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। চাকরিজীবনে তিনি রামু সেনানিবাস, টেকনাফ বিজিবি ও ব্যাটালিয়নে দায়িত্ব পালন করেন।
কেন ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন সিনহা?
সিনহা মো. রাশেদের অবসর-পরবর্তী জীবনের কথা উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, তিনি বিভিন্ন শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক এবং ভ্রমণ ও পর্যটন বিষয়ে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘JUST GO’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ চ্যানেলের ডকুমেন্টারি কনটেন্ট তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ভিডিওচিত্র ধারণ করতেন। এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য নিরলস কাজ করছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সিনহা মো. রাশেদ তাঁর সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাত, তাহসিন নুর রুপ্তি, শিপ্রা দেবনাথসহ মোট চার জন ২০২০ সালের ৩ জুলাই ভিডিওচিত্র ধারণ করার করার কাজে কক্সবাজারে আসেন এবং হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন।
সিনহাকে নিয়ে কেন উদ্বিগ্ন হলেন ওসি প্রদীপ?
ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলের ধরার জন্যই কাজ করছিলেন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে ২০২০ সালের ৭ জুলাই কক্সবাজারের রামু থানাধীন হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টের একটি কটেজে উঠেন। সেখানে তিনি আশপাশের চিত্রধারণসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং তা ভিডিওচিত্রে ধারণ শুরু করেন।
এরপর সিনহা মো. রাশেদ টেকনাফেও একই ধরনের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ শুরু করেন। তখন লোকমুখে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্য সংগ্রহ করার সময় ওসি প্রদীপের মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানার নিরীহ মানুষের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্য জানতে পারেন। নির্যাতনের শিকার অনেক ভিকটিম পরিবারের সদস্য সিনহা ও তাঁর সহযোগীদের কাছে প্রদীপের অত্যাচার-নীপিড়নের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন। এসব শুনে সিনহা ও তাঁর সহযোগীরা ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী ও তাঁদের পেটুয়া বাহিনীর নাম সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
ওসির হুমকিকে হালকাভাবে নিয়েছিলেন সিনহা
টেকনাফে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির এক পর্যায়ে ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদ এবং তাঁর সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতদের দেখা হয়ে যায়। তখন তাঁদের সঙ্গে ক্যামেরাসহ ভিডিও ধারণের নানা সরঞ্জাম ছিল। তাঁদের ওসি প্রদীপের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন প্রদীপ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং তাঁদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ওসি প্রদীপ এও বলেন, তিনি মেজর-টেজরের ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁদেরকে ভয়ভীতি দেখান ও হুমকি দেন এবং কক্সবাজার জেলা ছেড়ে যেতে বলেন। ওসি প্রদীপ তাঁদেরকে হুমকি দিয়ে বলেন, ইন্টারভিউ, ভিডিওচিত্র বানিয়ে ইউটিউবে প্রচার করে তাঁর কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এবং কর্তৃপক্ষকে জানালে মেজর সাহেব ও তাঁদেরকে ধ্বংস করে দেবেন। এরপর ওসি প্রদীপ তাঁর থানাধীন এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন এবং গোপন বৈঠক করেন। ওসি প্রদীপের হুমকির বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে সিনহা ও তাঁর সঙ্গীরা নিলীমা রিসোর্টে অবস্থান করেই প্রামাণ্যচিত্রের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
হুমকির পরেও সিনহা ও তাঁর দল কক্সবাজার না ছাড়ায় ওসি প্রদীপের সন্দেহ হয়, সিনহা মো. রাশেদ সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার পরিচয় দিয়ে টেকনাফে তাঁর থানাধীন এলাকায় তাঁর নানা কুকর্মের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে ক্ষতিগ্রস্ত ভিকটিম পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছেন। এসব অপকর্মের বিষয়গুলো প্রচার হলে তাঁর চাকরির বিরাট ক্ষতি হবে অনুধাবণ করে বিষয়টি তিনি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে জানান। এরপর তিনি থানা এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন এবং গোপন বৈঠক করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাঁদের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও আসামি মো. নিজাম উদ্দিনের মাধ্যমে সিনহা ও তাঁদের সঙ্গীদের সম্পর্কে খবরাখবর নেওয়ার চেষ্টা করেন। সিনহা ও তাঁর সঙ্গীদের দেখা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপ ও থানা পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে খবর দেওয়ার জন্য সোর্সদের বলেন। শুধু তাই নয়, প্রদীপ কুমার দাশের নির্যাতনে ক্ষতিগ্রস্ত টেকনাফ মডেল থানার হাম জালাল (৫০), মো. আলী আকবর (৪৪), ছেনোয়ারা বেগম (২৪), সালেহ আহমদ (৫০), বেবি বেগমদের (৩০) বাড়িতে সাদা পোশাকে পুলিশ পাঠানো হয় এবং সিনহা ও তাঁর ভিডিও টিমের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়। অভিযোগপত্রের ১৩ পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে মো. লিয়াকত আলী পুলিশের সোর্সদের সিনহা ও তাঁর ভিডিওদলকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন।
টেকনাফে প্রদীপের অপরাধের রামরাজত্ব?
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, আসামি প্রদীপ কুমার দাশ কক্সবাজারের মহেশখালী থানা থেকে ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে টেকনাফ মডেল থানায় যোগ দেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি মাদক নির্মূলের আড়ালে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে পেশীশক্তি প্রদর্শন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ী ছাড়াও স্থানীয় মোটামুটি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নিরীহ পরিবারকে টার্গেট করেন। এরপর তাঁদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে, অনেক লোকজনকে ক্রসফায়ার দিয়ে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে আদায়ের নির্মম নেশায় লিপ্ত হন।
ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় যোগদানের পর তাঁর নেতৃত্বে ও নির্দেশে শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় বহু লোক মারা যায়। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধ প্রক্রিয়া (মডাস অপারেন্ডি) ছিল কোনো ঘটনায় মাদক উদ্ধার হলে অথবা টার্গেট কোনো ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হলে (ফিটিং মামলা) প্রথমত আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর স্থানীয় কিছু শ্রেণির লোকজনসহ তাঁর নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের জন্য দেন-দরবার করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ক্রসফায়ার না দেওয়ার শর্তে আদায় করা হতো। প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ আশানুরূপ বা চাহিদা অনুযায়ী হলে ভিকটিমকে ক্রসফায়ারে না দিয়ে মাদক উদ্ধার দেখিয়ে উক্ত ব্যক্তির বা আসামির আত্মীয়-স্বজনদের মামলার আসামি করা হতো। এক্ষেত্রে নারী, বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী কেউ তাঁর আক্রোশ থেকে রেহাই পেত না। এমনকি নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও করা হতো বলে তদন্তে জানা যায় এবং এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আদালতে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। এরপর শুরু হতো তাঁর অন্যরকম অবৈধ অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, তাঁর দায়ের করা মামলার কথিত এজাহারে বর্ণিত আসামিদের ক্রসফায়ারের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ আসামির সৃজিত সম্পত্তি বেদখল করে এবং ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধভাবে আদায় করাই ছিল তাঁর নেশা ও পেশা। এ কাজ করার জন্য তিনি (প্রদীপ) তাঁর সমমনা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব পেটুয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন।
প্রদীপের এ ধরনের অপরাধকর্মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। যারা নূন্যতম প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছে, তারা এবং তাদের পরিবার ও নিকটাত্মীয়-স্বজন তাঁর অত্যাচার, নিপীড়নসহ মামলা-হামলার শিকার হতো। তিনি টেকনাফ মডেল থানায় যোগদান করেই স্থানীয় কিছু দালাল শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং মাদক নির্মূলের অজুহাতে ও নিজেকে সরকারের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক দেখানোর আড়ালে জনগণ তথা সরকারি দল-মতের তোয়াক্কা না করে, পুরো থানা এলাকায় এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে, সমাজ ও জনপদে ত্রাস সৃষ্টি করে অপরাধের অভয়ারণ্য ও অপরাধকর্মের রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর এ ধরনের অপরাধকর্মের প্রচার ও প্রসার রোধে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর দলবল স্থানীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে মুখ বন্ধ করে রাখতেন বলে জানা যায়। এতেও কাজ না হলে ভয়ভীতি-হুমকি প্রদর্শনসহ মামলায় জড়িয়ে কণ্ঠরোধ করা হতো। তাঁর কুকর্মের বিষয়ে কেউ যাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে এবং প্রচার করতে না পারে, সে বিষয়ে প্রদীপ কুমার দাশ ছিলেন সোচ্চার ও সতর্ক এবং এ ধরনের লোকজনের তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি তাঁর থানায় এলাকাভিত্তিক সোর্স নিয়োগ করে রাখতেন।
যেভাবে খুন করা হয় সিনহাকে
২০২০ সালের ৩১ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সিনহা মো. রাশেদ খান তাঁর সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে প্রতিদিনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ভিডিও ধারণ করার জন্য টেকনাফের মারিশবুনিয়ার মুইন্ন্যা পাহাড়ের উদ্দেশে প্রাইভেটকারযোগে রওয়ানা দেন। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নতুন মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে গাড়িটি পার্ক করে তাঁরা পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হন। তাঁর পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোশাকের মতো কমব্যাট প্যান্ট ও কমব্যাট গেঞ্জি এবং সঙ্গে ছিল ভিডিওধারণের ক্যামেরা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
পাহাড়ে ওঠার সময় মারিশবুনিয়ার মাথাভাঙ্গা জামে মসজিদের ইমামের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদের সালাম বিনিময় হয়। পথে একটি ছোট ছেলের কাছ থেকে তাঁরা পাহাড়ে ওঠার পথও জেনে নেন। এরপর তাঁরা ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করার জন্য মুইন্ন্যা পাহাড়ে ওঠেন। পরে পাহাড় ও সমুদ্রের চিত্র ধারণ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে। এর মধ্যে পুলিশের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াজ লোক মারফত জানতে পারেন, মুইন্ন্যা পাহাড়ে ভিডিও ধারণের জন্য দুজন লোক উঠেছে। তাঁরা আরও জানতে পারেন, তাঁদের একজন সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত এবং তাঁদের সঙ্গে ক্যামেরা আছে। এতে তাঁরা নিশ্চিত হন, এরাই সেই ভিডিও পার্টি, যাদের খুঁজে বের করার জন্য ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী তাঁদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন।
এরপর রাত ৮টার দিকে নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলীর পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী ডাকাত সাব্যস্ত করে গণপিটুনি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। সেজন্য দক্ষিণ মারিশবুনিয়া জামে মসজিদের মাইকে তাঁরা ঘোষণা করেন, পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে। তখন কিছু লোক জড়ো হয়। কিন্তু পাহাড়ে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় লোকজনের কাছে তাঁরা ডাকাতির বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এরপরও দমে যাননি নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ। তাঁরা মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. জহিরুল ইসলামকে দিয়ে মাইকে অনুরূপ ঘোষণা দেওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হাফেজ জহিরুল ইসলাম উপস্থিত লোকজনদের বলেন, উক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ সিনহা মো. রাশেদ খান ডাকাত নন, আর্মির লোক। পাহাড়ে ওঠার আগে তাঁর সঙ্গে মেজর সাহেবের দেখা হয়েছে এবং সালাম বিনিময় হয়েছে। এ কথা বলায় লোকজন চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর সিনহা মো. রাশেদ ও সিফাত পাহাড় থেকে আইয়াজ, নুরুল আমিন ও নিজাম উদ্দিনের সামনে দিয়ে নেমে যান। সে সময় নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ তাঁদের হাতে থাকা টর্চ লাইটের আলো ফেলে নিশ্চিত হন, এরাই সেই ভিডিও দল।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, এই তিন আসামি নুরুল আমিন, আইয়াজ ও নিজাম উদ্দিন সিনহা মো. রাশেদকে অনুসরণ করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যন্ত যান এবং তাঁরা কোন দিকে যাচ্ছেন, তা নিশ্চিত হন। সিনহা মো. রাশেদ তাঁরা নিজস্ব প্রাইভেটকার চালিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন—এ তথ্যটি আসামি নুরুল আমিন রাত ৮টা ৪৭ মিনিটে পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মোবাইল ফোনে জানান। এ ছাড়াও রাত ৮টা ৪৭ মিনিট থেকে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে নুরুল আমিন ও লিয়াকত আলীর ১৪/১৫ বার মোবাইলে কথোপকথন হয়। নুরুল আমিনের ফোন পেয়ে লিয়াকত আলী তড়িঘড়ি করে সঙ্গে কোনো ফোর্স না নিয়ে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ একটি মোটরসাইকেলে করে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে হাজির হয়ে সশস্ত্র অবস্থান নেন। তাঁরা সিনহা মো. রাশেদের গাড়িটি সেখানে আসার অপেক্ষায় থাকেন।
অভিযোগপত্রের ১৩ পাতায় তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে। এরপর রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে গাড়িটি শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছালে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্য রাজীব গাড়িটি থামার সংকেত দিলে তাঁরা গাড়িটি থামান। তখন রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে গাড়ির বাঁ পাশের আসনে বসা সিফাত গাড়ির জানালা খুলে দেন। এ সময় ড্রাইভিং সিটে বসা সিনহা মো. রাশেদ নিজের পরিচয় দেন। তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর রাজীব এবং অন্য দুজন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী ও আবদুল্লাহ আল মামুন ওরফে ইমন স্যালুট দিয়ে গাড়িটিকে চলে যাওয়ার সংকেত দেন।
সিনহা তখন গাড়িটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। হঠাৎ সিনহার নাম শুনেই মো. লিয়াকত আলী চিৎকার করে গাড়িটির সামনে চলে যান এবং আবার তাঁদের পরিচয় জানতে চান। পুনরায় মেজর (অব.) সিনহা নিজের পরিচয় দেন। তখন লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে আবার ব্যারিকেড তুলে রাস্তা বন্ধ করে দেন। এ কাজে এসআই নন্দ দুলালও সহযোগিতা করেন। এরপর লিয়াকত আলী পিস্তল তাক করে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সিনহা মো. রাশেদকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং গাড়ির সব যাত্রীকে দুহাত ওপরে তুলে নেমে আসতে বলেন। হঠাৎ তাঁর চিৎকারে রাস্তার দুই পাশে চলাচল করতে থাকা লোকজনও হকচকিত হয়ে যায় এবং ঘটনাস্থলে কী হচ্ছে, তা দেখার জন্য পথচারীরা দাঁড়িয়ে যান। এই চেকপোস্টটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সেখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার লাইট দিয়ে আলোকিত করা ছিল এবং এতে আশপাশের মসজিদ, বাজার ও রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন পরিষ্কারভাবে সব কিছু দেখতে পেত।
অভিযোগপত্রের ১৪ পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে হত্যাকাণ্ডের বর্ণণা দিয়ে বলা হয়, ওই সময় লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। তখন গাড়ির ২ নম্বর আসনে বসা সাহেদুল ইসলাম সিফাত দুহাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন। ড্রাইভিং সিটে বসা মেজর (অব.) সিনহাও দুহাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে কামডাউন, কামডাউন বলেন এবং লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
লিয়াকত আলী মেজর (অব.) সিনহার পরিচয় জেনে তাঁর কোনো কথা না শুনে এবং কোনো ধরনের সময় না দিয়ে তাঁকে লক্ষ্য করে প্রথমে দুই রাউন্ড গুলি করেন এবং কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন। এতে সিনহা মো. রাশেদ রাস্তায় পড়ে যান। গুলি করার পর লিয়াকত আলী মেজর (অব.) সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পড়ানোর নির্দেশ দেন। তখন এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত আহত সিনহাকে হাতকড়া পরান। কিন্তু, এসআই মো. শাহাজাহান আলীর কাছে হাতকড়া না থাকায় লিয়াকত তাঁকে গালমন্দ করেন এবং রশি এনে সিফাতকে বাঁধতে বলেন। তখন কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে ইমন পাশের শামলাপুর বাজারের দোকান থেকে রশি এনে এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল রাজিবের সহযোগিতায় সিফাতকে রশি দিয়ে বাঁধেন।
ঘটনার পর লিয়াকত আলী মোবাইল ফোনে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে এক মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথা বলেন এবং তিনি ওসি প্রদীপকে ঘটনাটি জানান। এর কিছুক্ষণ পর রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে লিয়াকত আলী ঘটনাটি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে (এসপি) জানান। সিনহা মো. রাশেদ তখনও জীবিত ও সজাগ ছিলেন এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে সিনহা একটু পানি খাওয়ার জন্য আকুতি-মিনতি করেন। এটা শুনে এবং তাঁকে তখনও জীবিত অবস্থায় দেখে লিয়াকত আলী আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তিনি সিনহাকে বলেন, তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য? এরপর লিয়াকত আহত সিনহার কাছে যান এবং বুকের বাঁ পাশে জোরে কয়েকটি লাথি মারেন এবং পা দিয়ে বুক চেপে ধরেন। এরমধ্যে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে কিছু পুলিশ পাঠাতে বলেন।
নন্দ দুলাল রক্ষিতের ফোন পেয়ে তদন্ত কেন্দ্র থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এএসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, ছাফানুল করিম ও কামাল হোসেন আজাদ সিএনজিতে করে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর লিয়াকত আলী এপিবিএন সদস্য এসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, কামাল হোসেন আজাদ ও ছাফানুল করিমকে সিনহা মো. রাশেদের গাড়িটি তল্লাশি করতে বলেন। তাঁরা গাড়ির ভেতরে সামনের দুই সিটের মাঝখান থেকে একটি অস্ত্র, ড্যাসবোর্ডে কিছু কাগজপত্র, ক্যামেরা, সিডিবক্স ও ভিডিও করার যন্ত্রপাতি পান। তখন সেখানে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি। পুরো ঘটনাটি রাস্তার দুপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী, পথচারী, মসজিদ, বাজার ও জেলেঘাটের লোকজন চেকপোস্টের পরিষ্কার আলোয় প্রত্যক্ষ করেন। সেদিন চাঁদ রাত হওয়ায় সেখানে লোক সমাগমও বেশি ছিল।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, লিয়াকত আলীর সফলতার ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ একটি সাদা মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপভ্যানে তাঁর সঙ্গীয় ফোর্সসহ দ্রুতগতিতে রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর প্রদীপ ও লিয়াকত আলী একান্তে কিছু সময় আলাপ করেন। তারপর প্রদীপ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা সিনহার কাছে যান। তখন প্রদীপ দম্ভোক্তি করে বলেন, অনেক টার্গেট নেওয়ার পর কুত্তার বাচ্চারে শেষ করতে পারছি। তারপর প্রদীপ প্রথমে সিনহাকে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখেন। সিনহা তখনও জীবিত ছিলেন এবং পানি চাচ্ছিলেন। প্রদীপ তখন তাঁর পায়ের জুতা দিয়ে সিনহার গলা চেপে ধরেন এবং এক পর্যায়ে সিনহার শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখনও প্রদীপ, লিয়াকত এবং সঙ্গীয় ফোর্সের কেউই সিনহার পড়ে থাকা দেহটিকে হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ না নিয়ে ঘটনাস্থলে ফেলে রাখেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ওসি প্রদীপ তাঁর সঙ্গীয় ফোর্সের মাধ্যমে মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি পুনরায় তল্লাশি করে মাদক খুঁজে বের করতে বলেন। তাঁর সঙ্গে আসা টেকনাফ থানার সাগর দেব ও রুবেল শর্মা নিজেদের বহনকারী মাইক্রোবাসের দিকে যান এবং এর কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে চিৎকার করে বলেন, সিনহার গাড়ির ভেতর মাদক পাওয়া গেছে।
এতপর ওসি প্রদীপের নির্দেশে তাঁর সঙ্গীয় ফোর্স সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের হাত বেঁধে চেকপোস্টের ভেতরে নিয়ে যান। সেখানে তাঁরা তাঁর মুখের ওপর পানি ঢেলে অবর্ণনীয় কায়দায় নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময়ের সব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সিনহা মো. রাশেদকে হাসপাতালে নেওয়ার কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রায় সোয়া ঘণ্টা বিলম্ব করা হয়েছে। সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী অস্বাভাবিক দেরিতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। পরে এএসআই লিটন, কনস্টেবল কামাল হোসেন আজাদ ও সাফানুল করিম মেজর (অব.) সিনহাকে একটি পিকআপে তুলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে যত চেষ্টা
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সিনহা কিছুক্ষণ পর মামলার অন্যতম সাক্ষী সার্জেন্ট মো. আইউব আলী আর্মি সিকিউরিটি ইউনিট (এএসইউ) রামু ক্যান্টনমেন্ট শামলাপুর আর্মি আরপি চেকপোস্টে থাকা অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন। তখন তিনি ঘটনাস্থল শামলাপুর চেকপোস্টে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান, পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ অন্যরা ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছেন। সার্জেন্ট আইউব আলী ঘটনাস্থলে গিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে চিনতে পেরে এবং তাঁকে গুরুতর জখম অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইলে সিনহার ছবি তোলেন। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা সার্জেন্ট আইউব আলীর পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাঁর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দেন। খবর পেয়ে রামু ক্যান্টনমেন্টের লেফটেন্যান্ট মুনতাছির আরেফিন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে উপস্থিত হন। তাঁর সঙ্গে সার্জেন্ট আইউব আলী তদন্ত কেন্দ্রের ভেতরে ঢোকেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে ওসি প্রদীপ উচ্চস্বরে কথা বলেন ও দুর্ব্যবহার করেন।
ঘটনার পর রামু সেনানিবাস থেকে সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যরা এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে উপস্থিত হন। সেখানে তাঁরা মেজর (অব.) সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ওসি প্রদীপসহ স্থানীয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। এরপরও ওসি প্রদীপ সিনহার পরিচয় সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে ঢাকায় অবস্থানরত তাঁর মাকে ফোন করেন এবং তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হন। তবে, সিনহার হত্যার ঘটনাটি তাঁর মায়ের কাছে গোপন করেন ওসি প্রদীপ। শুধু তাই নয়, হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সিনহা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে তিনটি বানোয়াট মামলা দায়ের করেন। এরপর প্রদীপের নির্দেশে সিনহার সহযোগী সিফাতকে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়া হয়। তাঁদের অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে রামু থানাধীন নিলীমা রিসোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁদের ভিডিও তৈরির কাজে ব্যবহৃত ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ একাধিক জিনিসপত্র জব্দ করা হয়। এসব যন্ত্রপাতি থানায় নিয়ে তাঁদের শ্যুট করা সব ভিডিও আলামত নষ্ট করা হয়।
চরিত্র হননের চেষ্টা
অভিযোপত্রে উল্লেখ করা হয়, আলামত নষ্ট করার পাশাপাশি সিনহা ও তাঁর সহযোগীদের চরিত্র হনন করার উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে গভীর রাতে নিলীমা কটেজে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে মাদক উদ্ধার দেখিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে আড়াল করার অপচেষ্টা চালানো হয়। এ ছাড়া সিনহা ও তাঁর সহযোগীদের চরিত্র হনন করার জন্য অপপ্রচার চালানো হয়। পরের দিন শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে সাজানো মাদক উদ্ধার মামলায় টেকনাফ মডেল থানার মাধ্যমে আদালতে চালান করা হয়।
সিনহার বোনের মামলা, আসামিদের আত্মসমর্পণ
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট খুন হওয়া মেজর (অব.) সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ২ নম্বর এবং বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়। বাকি ছয় আসামি হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫-কে। ৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা হলেন—লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।
তদন্তে আরও আট জন অভিযুক্ত
র্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। তাঁরা হলেন—ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩), আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। তাঁদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল এবং কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কক্সবাজারের এসপির উদাসীনতা
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মেজর (অব.) সিনহা হত্যার আগেও টেকনাফ থানার মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অপকর্মকাণ্ডের খবরাখবর প্রচারিত হওয়া সত্ত্বেও যথাসময়ে তা প্রতিরোধে কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদুর রহমান উদাসীন ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন স্বনামধন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ার সংবাদে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও ঘটনার অব্যবহিত পর ঘটনাস্থলে তৎকালীন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করা তাঁর অপেশাদ্বারিত্ব ও অবহেলামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সুপারের এসব আচরণ প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং জনমনে পক্ষপাতিত্বমূলক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে বলে মনে হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও অপরাধীদের শনাক্ত করার বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদুর রহমানের তদারকি এবং দায়িত্ব পালনে আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, সিনহা মো. রাশেদ খানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদ অবগত হওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোসহ ত্বরিৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সুপারের সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা বা মনিটরিং পরিলক্ষিত হয়নি। এ ছাড়া পুলিশ সুপারের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর তদারকিতে ঘাটতি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। পুলিশ সুপারের এমন অবহেলামূলক ও দায়িত্বহীন আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা যেতে পারে।