আল-জাজিরা নিয়ে শুনানিতে হাইকোর্ট, এত দিন পর কেন এলেন?
আল জাজিরার প্রতিবেদনটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। কোটি কোটি বার দেখা হয়ে গেছে। এত দিন পরে কেন? এখন বন্ধ করলে সুফল কোথায়? আমরা প্রায়ই দেখি; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কোনো স্ট্যাটাস দিলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এত দিনে কোনো কিছু করতে পারলেন না কেন? বিটিআরসি এতদিন কী করল, আপত্তিকর কিছু সম্প্রচার বন্ধে বিটিআরসির ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন আদালতের কাঁধে বন্দুক রাখা হচ্ছে।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হাসান মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আজ বুধবার প্রশ্ন করেন। কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশনে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশে টেলিভিশনটির সম্প্রচার বন্ধ এবং ওই ভিডিও কনটেন্ট ইউটিউব, ফেসবুকসহ সব অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিকালে আদালত এ প্রশ্ন করেন। হাইকোর্টের আইনজীবী মো. এনামুল কবির ইমন গত সোমবার ওই রিট আবেদন করেন।
আজ দুপুর পৌনে ১২টা দিকে হাইকোর্টের ভার্চুয়াল আদালতে শুনানির শুরুতে আইনজীবী মো. এনামুল কবির ইমন আদালতকে বলেন, মাই লর্ড, কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। দেশের নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। বাংলাদেশকে মাফিয়া রাষ্ট্র হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে।
তখন আইনজীবীর কাছে আদালত জানতে চান, আপনারা কী চান?
এ সময় মো. এনামুল কবির ইমন বলেন, এ নিউজ ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টগ্রামসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, যা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের লঙ্ঘণ। তাই এ টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ করার আবেদন করছি। তিনি আরো বলেন, আল জাজিরায় প্রচারিত ওই ভিডিও কন্টেন্টটি অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে অপসারণে বিটিআরসির নিস্ক্রিয়তা রয়েছে।
জবাবে আদালত জানতে চান, আপনি কী রিটের আগে আল জাজিরা কর্তৃপক্ষ এবং বিটিআরসিকে কোনো নোটিশ দিয়েছেন?
তখন আইনজীবী আমতা আমতা করে বলেন, ‘নো, মাই লর্ড।’
আদালত বলেন, আপনি আমাকে দুটি প্রশ্নের উত্তর দেন? একটি হলো, আপনি তো এ ঘটনায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নন। আপনি আল জাজিরা টিভির সম্প্রচার বন্ধ করার আবেদন করতে পারেন কি না? দ্বিতীয়ত, এটি একটি ভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেল। বাংলাদেশের হাইকোর্ট আল জাজিরা টিভির সম্প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিতে পারে কি না?
জবাবে রিটকারী আইনজীবী বলেন, মাই লর্ড দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এবং আমার সাংবিধানিক অধিকার বলে আমি এ আবেদন করেছি। আর বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।
জবাবে আদালত বলেন, আপনি বিটিআরসিকে নোটিশ প্রদান করেননি কেন? তখন আইনজীবী মো. এনামুল কবির ইমন চুপ থাকেন।
এ সময় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, রিট করার পূর্বে নোটিশ দিতে হয়। আপনি তো প্রোপার ওয়েতে আসেননি। হাইকোর্ট কী আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করতে পারবে? তখন মো. এনামুল কবির ইমন বলেন, দেশের জাতীয়তাবাদে আঘাত করা হয়েছে বলে আমি দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এটি করেছি।
আদালত এ পর্যায়ে জানতে চান, এ নিউজ কবে সম্প্রচার করা হয়েছে? জবাবে আইনজীবী মো. এনামুল কবির ইমন বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি সম্প্রচার করা হয়েছে।
আদালত তখন জানতে চান, আপনারা এত দিন কী করেছেন? ১০ দিন পরে এলেন। এত দিনে সারা বিশ্বের মানুষ প্রতিবেদনটি দেখেছে। এখন বন্ধ করে কী লাভ? জবাবে আইনজীবী বলেন, দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইএসপিআর এবং পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তখন আদালত বলেন, এত দিনে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি, এটা তো পুরোপুরি অবিশ্বাস্য? এ সময় রিটকারি আইনজীবী কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন।
তখন শুনানিতে যুক্ত হন বিটিআরসির পক্ষের আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই-রাকিব। তিনি বলেন, মাই লর্ড আমি বিটিআরসির প্যানেল আইনজীবী।
আদালত তখন জানতে চান, আপনি কেন যুক্ত হয়েছেন? জবাবে রেজা-ই রাকিব বলেন, মাই লর্ড এখানে আমি বিটিআরসির আইনজীবী হিসেবে যুক্ত হয়েছি। বিটিআরসি চাইলে আল জাজিরা টিভির সম্প্রচার বন্ধ করতে পারবে না। কারণ এটি কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক একটি টিভি চ্যানেল। আদালত চাইলেও ভিন্ন দেশের কোনো টিভি চ্যানেল বন্ধের নির্দেশ দিতে পারেন না। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিউজের সাথে রং মাখিয়ে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হচ্ছে। এসব প্রোপাগাণ্ডা বন্ধ করতে আদালত নির্দেশ দিলে বিটিআরসি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারে এবং তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
এ সময় হাইকোর্ট জানতে চান, এ ব্যাপারে আদালতের এখতিয়ার আছে কি না? জবাবে খন্দকার রেজা-ই-রাকিব বলেন, এখানে জটিলতা আছে। সম্প্রচার বন্ধের বিষয়টি সম্পূর্ণ তথ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। মাই লর্ড, আমরা (বিটিআরসি) কোনো টেলিকাস্ট বন্ধ করতে বা ওটিটি প্লাটফর্ম থেকে ভিডিও সরাসরি সরাতে পারি না। তবে আদালত কোনো আদেশ দিলে আমরা ভিডিও কন্টেন্টগুলো সরানের জন্য ওটিটি প্লাটফর্ম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করি। সে ক্ষেত্রে তারা পদক্ষেপ নেয়।
এ সময় আদালত বলেন, এটি তো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। কোটি কোটি বার দেখা হয়ে গেছে। বিটিআরসি এতদিন কী করল, আপত্তিকর কিছু সম্প্রচার বন্ধে বিটিআরসির ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন আদালতের কাঁধে বন্দুক রাখা হচ্ছে। এত দিন পরে বন্ধ করলে এর সুফল কোথায়? আদালত আরও বলেন, আমরা প্রায়ই দেখি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কোনো স্ট্যাটাস দিলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এত দিনে কোনো কিছু করতে পারলেন না কেন?
জবাবে খন্দকার রেজা ই রাকিব বলেন, মাই লর্ড, আমরা শুনছি আল জাজিরায় আরো পর্ব আসবে, যা দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আদালত আদেশ দিলে বিটিআরসি কেবল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।
রিটকারী এবং বিটিআরসির আইনজীবীর শুনানি শেষে হাইকোর্ট বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধে আদেশ দিতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য ছয়জন আ্যমিকাস কিউরি (আদালত-বন্ধু) নিয়োগ দেন। তাঁরা হলেন এ জে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল, আব্দুল মতিন খসরু, কামালুল আলম, প্রবীর নিয়োগী ও ড. শাহদীন মালিক। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বক্তব্য শোনার জন্য দিন ধার্য করেন আদালত। একইসঙ্গে আদেশের কপি দ্রুত তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
গত সোমবার হাইকোর্টে করা ওই রিটে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, তথ্যপ্রযুক্তি সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।