এসপি বাবুল শেল্টার দিতে চেয়েছিলেন, মুসার স্ত্রীর দাবি
চট্টগ্রামে মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার দাবি করেছেন, সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের নির্দেশে তাঁর স্বামী এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
পান্না আক্তার আরও দাবি করেন, ‘মিতু হত্যাকাণ্ডের পর আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। তারপর আমি এ হত্যার বিষয়ে মুসার কাছে কয়েকবার জানতে চেয়েছিলাম। প্রথমে মুসা কিছু বলছিল না। পরে এক সময় মুসা আমাকে জানায়, বাবুলের নির্দেশে সে হত্যাকাণ্ডে জড়িত হতে বাধ্য হয়েছে।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের সঙ্গে এনটিভি অনলাইনের কথা হয়। সে সময় তিনি বলেন, ‘আমি মুসার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তোমরা কেন এমন একটি জঘন্য কাজ করলে? এখন আমার সন্তানদের কী হবে? আমার কী হবে? তখন মুসা জানিয়েছিল, বাবুল আক্তার তাকে শেল্টার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাবুল আমার স্বামীকে চিন্তা না করতে বলেছেন। কিন্তু তারপর আমার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। সেখান থেকে আজ পাঁচ বছর আমি মুসার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমি মুসার খোঁজ চাই।’
‘মুসাকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন বাবুল আক্তার। মুসা রাজনীতি করত, বিএনপির সমর্থক ছিল। ২০১৩ সাল থেকে মুসা এসপি বাবুল আক্তারের সোর্স ছিল বলে আমি জেনেছি। মিতুকে হত্যার পর মুসার ফোনেও বাবুল আক্তার কল দিয়েছিলেন। আমি ধরেছিলাম। তখন বাবুল আক্তার জানতে চান, মুসা কোথায়? আমি বলেছিলাম, বাইরে গেছে। তখন বাবুল ফোনে আমাকে বলেছিলেন, মুসাকে সাবধানে থাকতে বলবা। তারপর থেকে আমার সন্দেহ আরও বাড়ে’, যোগ করেন পান্না আক্তার।
২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম মহানগরের জিইসি মোড় এলাকায় মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপর তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন। জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি।
প্রায় পাঁচ বছর পর মিতু হত্যায় ‘চাঞ্চল্যকর’ তথ্য সামনে নিয়ে আসে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মিতু হত্যার পর মামলার বাদী হয়েছিলেন তাঁর স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। পাঁচ বছর পর সেই বাবুল আক্তারই এখন মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামিতে পরিণত হয়েছেন। পিবিআই দাবি করেছে, মিতু হত্যাকাণ্ডে তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার সম্পৃক্ত ছিলেন। আর বাবুলের ‘বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের’ জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
‘বাবুলকে ভয়, তাই মুখ খুলিনি’
মিতু হত্যার প্রায় পাঁচ বছর পর ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছেন, আগে কেন বলেননি- এমন প্রশ্নে পান্না আক্তারের দাবি, ‘সন্তান, পরিবার ও আমার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আগে কথা বলিনি। আমি বাবুল আক্তারকে ভয় করতাম। বাবুল আক্তারের পরিচিত কিছু পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনার পর থেকে আমাকে হুমকি দিতেন, আমি তাদেরকে ভয় পেতাম। আমি জানতাম, মুসা এ ঘটনায় জড়িত; সেজন্য ভয় পেতাম। সব মিলিয়ে আমি আগে মুখ খুলিনি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আজ পাঁচ বছর আমার স্বামী নিখোঁজ। তার সন্ধান চাই আমি। মামলার জন্য হলেও তো মুসাকে দরকার। কারণ সে সবকিছু জানে।’
পান্নার সংবাদ সম্মেলনে বাবুল-ঘনিষ্ঠদের বাধা
মুসার স্ত্রী দাবি করেন, ঘটনার পর ২০১৬ সালের ২৫ জুন তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠ দুই কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলন করতে নিষেধ করেছিলেন। তারপরও তিনি ওই বছরের ৫ জুলাই আবার সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। তখনও করতে দেওয়া হয়নি। সে সময় তিনি বাবা ও শ্বশুরের বাড়ি রাঙ্গুনিয়াতে থাকতেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে চট্টগ্রামও যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। আমি এ ব্যাপারে কথা বললে আমাকে জঙ্গি বানিয়ে গ্রেপ্তার করা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আমি প্রচণ্ড ভয়ে থাকতাম।’
পিবিআইকে সব বলেছে পান্না
পান্না আক্তার বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বর মাসে মুসার ব্যাপারে জানতে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আমি যা যা জানি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। যা যা আমি জানতাম, সবই আমি বলেছিলাম। তারপর থেকে মূলত আমি চিন্তা করা শুরু করি, এ ব্যাপারে আমি কথা বলব। এখন বাবুল আক্তার জেলে। আমার ক্ষতি হবে না বলে আমি মনে করছি। সেজন্য এখন কথা বলছি।’
মুসা ‘পলাতক’, বিশ্বাস করেন না পান্না
পুলিশ বলছে, মুসা ‘নিখোঁজ’। কিন্তু পান্নার দাবি, মুসা পুলিশের কাছেই আছে। কেন এমন দাবি আপনার, জানতে চাইলে পান্না আক্তার বলেন, ‘আমার চোখের সামনে কাঠঘর তিন রাস্তার মোড় থেকে পুলিশ মুসাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর পুলিশ আমাকে গাড়িতে করে বাড়িতে রেখে যায়। ওইদিনই পুলিশ আমার বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে। পুলিশ তখন বলে, মুসাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। ২০১৬ সালের ২২ জুন সকালে আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে। আর এখন পুলিশ বলছে, মুসা পলাতক। এটা আমি বিশ্বাস করি না। মুসা যদি পলাতক হতো বা বিদেশে চলে যেত, তাহলে তার পাসপোর্ট আমার কাছে কীভাবে থাকে?’
‘সুদান থেকেও বাবুল সোর্স মুসার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন’
পান্না আক্তার দাবি করেন, ‘মুসা পুলিশের সোর্স ছিলেন। মিতুকে হত্যার আগে ও পরে সব সময় বাবুল আক্তার মুসার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। রাতে মাঝেমধ্যে অনেক সময় করে কথা বলতেন। বাবুল যখন সুদান চলে যায়, তখনও মুসার সঙ্গে কথা বলতেন। এরপর মিতুকে খুন করা হলো। তারপর পুলিশ আমাদের ভাড়া বাসায় গিয়ে তল্লাশি করে। সে সময় আমি রাঙ্গুনিয়ার বাবার বাড়িতে ছিলাম। বাবা অসুস্থ ছিলেন। পরে মুসাও রাঙ্গুনিয়ায় চলে যায়। পরে বাবুল ফোন করে মুসার সঙ্গে কথা বলেন। তখন আমার সন্দেহ হয়। এরপর চাপাচাপি করি কী বিষয়ে কথা হয়েছে জানতে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে মুসা বললেন, বাবুল তাকে খুন করতে বলেছিলেন। মুসা আমাকে বলেছিল, সে প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু মুসাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে বলে খুন করতে বাধ্য করা হয়।’
পিবিআইয়ের সন্দেহেও মুসা, অনেক প্রশ্ন
আলোচিত এই মামলার দিন যত গড়িয়েছে গতিপথও তত পাল্টেছে। ‘বাঁক পরিবর্তনের’ প্রথম সূত্রটি আসে একটি ফোন কলের ভিত্তিতে। পুলিশের দাবি, সেখানে বাবুল আক্তার একজন ‘খুনি’র সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপরই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারের নাম।
এ বিষয়ে বুধবার পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান ও পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজে মুসাকে দেখা যায়। সে ছিল বাবুল আক্তারের সোর্স। মুসা নিয়মিত বাবুল আক্তারের বাসায় যেতেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুসা বাজারও করে দিতেন।’
কিন্তু বাবুল আক্তার কখনোই মুসাকে শনাক্ত করেননি। কেন করেননি- সেই প্রশ্নও ছিল পিবিআইয়ের।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘পিবিআই জানার চেষ্টা করেছে, মুসা সোর্স ছিলেন কি না? এটাই পিবিআই প্রমাণের চেষ্টা করেছে। মিতু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে জঙ্গি কার্যক্রমে আহত হন বলে দাবি করেন বাবুল। মৃত্যুর পর যে আচরণ, তা ছিল আপনজন হারানোর মতোই। তাই তাঁর কথা সবাই বিশ্বাস করেছিলেন।’