ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান রাষ্ট্রপতির
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে দল-মতের পার্থক্য ভুলে আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।
আজ সোমবার বিকেলে রাষ্ট্রপতির ভাষণে আবদুল হামিদ এ কথা বলেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রতি বছরের প্রথম অধিবেশনে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছ। ২০২১ সালের প্রথম অধিবেশন এটি। নিয়ম অনুযায়ী এ ভাষণে আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে এবারের অধিবেশন মোটামুটি সংক্ষিপ্ত হবে।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের সময় করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে অংশ নেন।
সংসদে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে আমাদের আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আসুন, দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।
জাতীয় সংসদকে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু উল্লেখ করে সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার ভাষণে আবদুল হামিদ বলেন, গণতন্ত্রায়ন, সুশাসন ও নিরবচ্ছিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে তিনি সরকারি দল ও বিরোধী দলকে মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন, শত বাধা বিঘ্ন আর প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সরকার দেশের উন্নয়ন, সুশাসন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ভাষণদানকালে রাষ্ট্রপতি অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন। এ ছাড়া দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি।
আবদুল হামিদ বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ২৪টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ২০২০ সালে উন্নয়ন খাতে প্রায় এক হাজার ৫৩২ কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুতীকরণসহ প্রায় এক হাজার ৪১৬ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশস্তকরণ, ৮৫টি সেতু ও ৭৫২টি কালভার্ট নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’র দুই প্রান্তের মাওয়া ও জাজিরা সংযোগকারী সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপন করার মাধ্যমে সেতুর ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ জুলাই ২০২২ সাল নাগাদ সমাপ্ত হবে। এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের সমম্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
আবদুল হামিদ বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু লেন বিশিষ্ট টানেলের নির্মাণকাজ ডিসেম্বর ২০২২ সাল নাগাদ সম্পন্ন হবে। ইতোমধ্যে টানেলের প্রথম টিউবের নির্মাণ শেষে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর থেকে দ্বিতীয় টিউবের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে ১১টি রুটের ২৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবওয়ে নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ২০২১ সালের জুন নাগাদ সমাপ্ত হবে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বালিয়াপুর থেকে নিমতলী-কেরানীগঞ্জ-ফতুল্লা-বন্দর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ পর্যন্ত ৩৯ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া করোনা মহামারি পরিস্থিতিতেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে সব ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। সম্প্রতি সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সাফল্যের সঙ্গে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ।
‘বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের মতো আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ অর্থনীতির সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনাসহ ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে নানামুখী দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। শেখ হাসিনার দৃঢ়, প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে এসব উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।’
আবদুল হামিদ বলেন, এর ধারাবাহিকতায় প্রথিতযশা সাময়িকী ‘ফোর্বস’ কর্তৃক প্রকাশিত বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফল রাষ্ট্রনায়ক ও নারী নেতৃত্বের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
কোভিড-১৯ জনিত প্যানডেমিকের সফল মোকাবিলা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও জীবনমান সচল রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ প্রণীত ‘কোভিড-১৯ সহনশীল র্যাংকিং’-এ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং বিশ্বে ২০তম স্থান অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে। এজন্য রাষ্ট্রপতি তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অব লাইফ সায়েন্সেস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সিএমএসডির মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিন ক্রয় বাবদ ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদান করা হয়।’
রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন, সরকার খুব শিগগিরই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯-এর টিকা প্রদান করতে পারবে।
আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপ্রধান হামিদ বলেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষ সাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্ব নীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষা, জনগণের আমানতকৃত অর্থের সুরক্ষা, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি এবং আর্থিক লেনদেন সহজীকরণের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বেকার যুবদের আত্মকর্মসংস্থান এবং বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনকারীদের ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্য সরকার কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনকে দুই হাজার কোটি টাকার তহবিল প্রদান করেছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে দুই লাখ প্রশিক্ষিত বেকার যুবদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ’ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
গত এক দশকে গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও পর পর তিন বছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক এক-পাঁচ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এ ধারাবাহিক অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। এ বছর মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে আমরা স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী পালন করব।’