ওসি প্রদীপের অপকর্ম জেনেও উদাসীন ছিলেন এসপি
২০২০ সালে ৩১ জুলাই মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের আগেও টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের নানা অপকর্ম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কক্সবাজার জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদুর রহমান। কিন্তু, তিনি প্রদীপ বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উদাসীন ছিলেন। তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীন এসব আচরণের কারণে এসপির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
সিনহা হত্যাকাণ্ডের চার মাস পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি এ বি এম মাসুদুর রহমান সম্পর্কে এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা—সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। প্রায় এক বছরের শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষে আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি (সোমবার) আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল।
অভিযোগপত্রের ১৬ পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, মেজর (অব.) সিনহা হত্যার আগেও টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের অপকর্মকাণ্ডের খবরাখবর প্রচার হওয়া সত্ত্বেও যথাসময়ে তা প্রতিরোধে কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদুর রহমান উদাসীন ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বনামধন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ার সংবাদে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও ঘটনার অব্যবহিত পরে ঘটনাস্থলে তৎকালীন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করা তাঁর অপেশাদারি ও অবহেলামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমানের এসব আচরণ প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং জনমনে তাঁর পক্ষপাতিত্বমূলক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে বলে মনে হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন এবং অপরাধীদের শনাক্ত করার বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদুর রহমানের তদারকি এবং দায়িত্ব পালনে আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়—নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান গুলিবদ্ধ হওয়ার সংবাদ অবগত হওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোসহ ত্বরিত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সুপারের সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা বা মনিটরিং পরিলক্ষিত হয়নি। এ ছাড়া পুলিশ সুপারের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর তদারকিতে ঘাটতি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। পুলিশ সুপারের এমন অবহেলামূলক ও দায়িত্বহীন আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা যেতে পারে।
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) ২ নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে (৩০) ৩ নম্বর আসামি করা হয়। বাকি ছয় আসামি হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫ কে। ৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা হলেন—লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।
র্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। তাঁরা হলেন—ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। তাঁদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন।
অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আদালত ৩১ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন। মামলার শুনানিতে আসামিদের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।