ওসি প্রদীপের ‘রাজত্বে হুমকি হওয়ায়’ সিনহাকে হত্যা
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলজুড়ে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার যে ‘অবৈধ মাদক বাণিজ্য ও ভয়ভীতি-নির্যাতনের’ পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন সেটি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান জেনে ফেলেছিলেন বলেই তাঁকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করার পর মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এমনটাই দাবি করেছে।
আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১৫-এর সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪-এর বিচারক তামান্না ফারাহর আদালতে এই অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে অভিযোগপত্র নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সংস্থার আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মূল যে বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবেই আদালতের নজরে এনেছেন সেটি হলো, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রত্যক্ষদর্শী, বিভিন্ন পর্যায়ের সাক্ষীর সাক্ষ্য, আলামত ও আসামিদের জবানবন্দিসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এই মর্মে বস্তুনিষ্ঠভাবে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ঘটনাটি ঘটেছিল ৩১ জুলাই রাত ৯টা ২৫ মিনিটে বাহারছাড়া তদন্তকেন্দ্রে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস। মূল পরিকল্পনাকারী এই হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এবং বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।’
র্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘প্রদীপ কুমার দাসের প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে পরিদর্শক লিয়াকত আলীর সঙ্গে আরো পাঁচজন অর্থাৎ পুলিশের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মো. আইয়াত ওরফে আইয়াজ, মো. নিজামউদ্দিন ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন। এবং মো. লিয়াকত আলী কর্তৃক ও এসআই নন্দ দুলালের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং তিনজন এপিবিএনের সদস্যের সহায়তায় এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেন।’
‘পরবর্তীতে আরো প্রত্যন্ত ফাঁড়ির সদস্যরা আহত মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যু নিশ্চিত করা এবং ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার কারণে এসআই লিমন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন আজাদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য লিয়াকত ও প্রদীপ কুমার দাসকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন।’
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘এই হত্যা মামলায় পলাতক থাকা কনস্টেবল সাগর দে এবং গ্রেপ্তার রুবেল শর্মা- তারা ঘটনার যে একটি নাটক তৈরি করেন সেটি হচ্ছে, ভিকটিমের গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের ঘটনা এবং পরবর্তীতে এ ঘটনাকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করার জন্য একটি আবহ তৈরি করেন। এই ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত।’
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আরো জানান, চলতি বছরের জুলাইয়ের ৭ তারিখে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ, শহিদুল ইসলাম সিফাত ও আরেক সহযোগী রুপ্তি তারা নীলিমা রির্সোটে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে সেখান থেকে রুপ্তি চলে আসেন। মূলত তাঁদের সেখানে ভিডিও ধারণ অর্থাৎ একটি ইউটিউব চ্যানেল লঞ্চ করার পরিপ্রেক্ষিতে টেকনাফের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এক ধরনের আন্তরিকতা গড়ে উঠে।
‘সেখানেই মূলত ওসি প্রদীপের সম্পর্কে নির্যাতনের ঘটনা এবং ইয়াবা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়, এ ধরনের পরিস্থিতির বিষয়ে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সম্পূর্ণভাবে জানতে পেরেছিলেন। এ বিষয়ে ক্যামেরাসহ ওসি প্রদীপের একটি বক্তব্য নিতে চান। এরই মধ্যে ওসি প্রদীপ তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে যায়। ফলশ্রুতিতে ওসি প্রদীপ তাদের এ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। একপর্যায়ে ওসি প্রদীপ তাদের সরাসরি হুমকি প্রদান করে এ বিষয়ে বিরত থাকতে বলেন।’
আশিক বিল্লাহ আরো বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে ওসি প্রদীপ এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার একটি হলো, ওসি প্রদীপের যে বাণিজ্য, নিজস্ব একটি অভয়াশ্রম তৈরি করেছিলেন, সেই অভয়াশ্রমকে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা এবং এসব বিষয়ে যেহেতু সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সম্মুখভাবে সব জেনে ফেলেছিলেন, এ বিষয়টি যাতে কর্তৃপক্ষকে না জানান। এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখে ওসি প্রদীপ তাদের প্রত্যক্ষ হুমকি প্রদান করেন। কিন্তু সিনহাসহ তাঁর সহযোগীরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে পরিদর্শক লিয়াকত ও প্রদীপসহ তার সোর্সরা মিলে এ ধরনের একটি ন্যক্কারনজক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন।’
গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে আলোচিত মামলাটির অভিযোগপত্র আজ দাখিল করেছে র্যাব।
এদিকে আজ সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলা বাতিল চেয়ে প্রধান আসামি বরখাস্ত হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর পক্ষে করা রিভিশন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। উভয়পক্ষের যুক্ততর্ক ও শুনানি শেষে আবেদনটির গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় খারিজ করে দেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
মেজর সিনহা হত্যার পর গত ৫ আগস্ট তাঁর বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে।
এরপর আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে র্যাব হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিনজন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ১৪ জনই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
কারাগারে থাকা ১৪ আসামি হলেন—বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।