কবর থেকে তোলা হচ্ছে রায়হানের লাশ
সিলেট নগরীর বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হান উদ্দিন আহমদের লাশ উত্তোলনের কার্যক্রম শুরু করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সদস্য আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় নগরীর নেহারীপাড়ায় আখালিয়া নবাবী মসজিদ কবরস্থানে গিয়ে রায়হানের কবরের চারপাশে ক্রাইম সিন ফিতা টেনে দেয়। এরপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সজিবুর রহমান ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেজবাহ উদ্দিনের উপস্থিতিতে লাশ ওঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। লাশ উত্তোলন করে প্রথমে সুরতহাল তৈরি করা হবে। পরে তা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে।
লাশ উত্তোলনের সময় পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও স্থানীয় কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান উপস্থিত আছেন।
এর আগে গতকাল বুধবার রায়হানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়নাতদন্তের অনুমতি দেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক এম. কাজী এমদাদুল ইসলাম।
এ ব্যাপারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খালেদুজ্জামান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আমরা রায়হানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করব। এরপর ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতেই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হবে।’
খালেদুজ্জামান জানান, হেফাজতে মৃত্যু আইনে মামলা হলে নিহত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি ছাড়াই ময়নাতদন্ত করে রায়হানকে কবর দেওয়া হয়।
এ কারণে পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ কবর থেকে উত্তোলনের আবেদন করেছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল বাতেন। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই রায়হান আহমদের মরদেহ কবর থেকে তোলার অনুমতি দেন জেলা প্রশাসক।
নিহত রায়হান সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারীপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। মৃত্যুর পর গত রোববার সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ মর্গে তাঁর ময়নাতদন্ত করা হয়। সেদিনই লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের পর দাফন করা হয়।
রায়হানকে বন্দর বাজার ফাঁড়িতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এ ঘটনার পর গত সোমবার বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যাহার করা হয় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে।
রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় গত রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে তাঁর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত রাখা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনের মতো গত শনিবার বিকেল ৩টায় রায়হান উদ্দিন আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রানীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হয়। তখন তাঁর ফোন বন্ধ পায় পরিবার। ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তাঁর মায়ের কাছে ফোন দেন। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাঁকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন।
রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন, তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, ‘পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাঁকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তাঁরা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’