করোনায় একজন মুশফিক আরিফের অনন্য দৃষ্টান্ত
মুশফিক আরিফ। একজন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সংবাদকর্মী। স্থানীয় উন্নয়নে নাগরিক অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে সব সময় সোচ্চার তিনি। বরগুনা প্রেসক্লাবের অন্যতম সদস্য, খেলাঘর বরগুনার সাধারণ সম্পাদক এবং একটি বেসরকারি টেলিভিশনের বরগুনা প্রতিনিধি তিনি।
সম্প্রতি করোনা মহামারি মোকাবিলায় ফেসবুকে আবেদন জানিয়ে মাত্র ২২ দিনে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ, দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বরগুনাবাসীকে সম্পৃক্ত করেন। এর মাধ্যমে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের জন্য প্রায় ১৫ লাখ টাকার চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
বিশ্বে করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে সবাইকে সম্পৃক্ত করে এমন উদ্যোগ সারা দেশের জন্য অনুস্মরণীয় বলে মনে করছে স্থানীয় সচেতন মহল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘আমাদের জন্য আমরা’ স্লোগান নিয়ে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এর পর বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সংকটাপন্ন রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ‘হাই ফ্লো নেজাল কেনুলা মেশিন’ ক্রয়ের আবেদন জানিয়ে গত ২২ জুন ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন মুশফিক আরিফ।
মাত্র ২২ দিনের মধ্যে মুশফিক অরিফের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নগদ অর্থ ও হাই ফ্লো নেজাল কেনুলা মেশিনসহ প্রায় ১৫ লাখ টাকার চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সংগ্রহ হয়। মুশফিক আরিফের প্রচেষ্টায় বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে এখন পর্যন্ত যোগ হয়েছে চারটি হাই ফ্লো নেজাল কেনুলা মেশিন।
জানা যায়, বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে একটিমাত্র হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা মেশিন ছিল, যা রোগীর সংখ্যার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
এ বিষয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের একমাত্র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুল আজাদ বলেন, “যেহেতু এ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন মেনিফোল্ড সিস্টেম আছে সেহেতু ‘হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা’ মেশিন ক্রিটিক্যাল করোনা রোগীদের জন্য অনেকটাই সাপোর্ট দেবে।”
ডা. কামরুল আজাদ আরো বলেন, ‘সাধারণ সিলিন্ডারের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে সাধারণত ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন দেওয়া যায় না। এ কারণে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে তখন আইসিইউ প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই মেশিনের মাধ্যমে একজন রোগীর জন্য প্রতি মিনিটে ৭০ থেকে ৮০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। তা ছাড়া আইসিইউ কিংবা ভেন্টিলেটর পদ্ধতিতে যেমন হাইলি স্কিল্ড ম্যানপাওয়ার লাগে, এই মেশিন ব্যবহারে তার প্রয়োজন হয় না। যেকোনো চিকিৎসক, নার্স বা টেকনোলজিস্ট এটা একবার দেখেই ব্যবহার করতে পারেন।’
ডা. আজাদ ‘আমাদের জন্য আমরা’ উদ্যোগের বিষয়ে বলেন, ‘এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়দের সহযোগিতায় বরিশাল বিভাগের মধ্যে এখন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালেই সর্বাধিক হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা মেশিন সংযুক্ত হলো। যা সত্যিই একটি ভিন্ন উদাহরণ। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এসব মেশিন করোনা রোগীর চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এবং হাসপাতালের চিকিৎসার মানও বাড়বে।’
এ বিষয়ে ‘আমাদের জন্য আমরা’ উদ্যোগের প্রধান সমন্বয়কারী সাংবাদিক মুশফিক আরিফ বলেন, ‘আমরা শুধু শুরুটা করেছি। আমাদের ওপর আস্থা রেখে বাকিটা সম্পন্ন করেছে বরগুনার স্থানীয় সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে ভাবেন এমন প্রিয়জনরা। এখানে সব কৃতিত্ব তাঁদের, যাঁরা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন।’
এ কাজের পেছনে মুশফিক আরিফ সরাসরি তাঁকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে সহযোগিতার করার জন্য বরগুনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল আলীম হিমু, সাংবাদিক হাসানুর রহমান ঝন্টু, মনির হোসেন কামালসহ সব সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
মুশফিক আরিফ আরো বলেন, ‘এ পর্যন্ত মাত্র ২২ দিনে ব্যক্তি পর্যায়ে ১৭৩ জন এবং আটটি সংগঠন এই তহবিলে অর্থায়ন করেছে। কেউ কেউ সরাসরি মেশিনও কিনে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত নগদ অর্থ সংগ্রহ হয়েছে ১০ লাখ ৭৬ হাজার ১৬০ টাকা, যার পুরোটাই করোনা চিকিৎসা সহায়তায় ব্যয় করা হবে। এ ক্ষেত্রে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিৎ করতে এই তহবিলে সংগৃহীত অর্থের যাবতীয় আয় ব্যয়ের হিসাব প্রতিদিন ফেসবুকে আপডেট দেওয়া হচ্ছে।’
এ বিষয়ে বরগুনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বরগুনার সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সাংবাদিক আব্দুল আলীম হিমু বলেন, ‘বরগুনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংকটে এমন অনেক মহৎ কাজের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে।’ তিনি তরুণ সাংবাদিক মুশফিক আরিফকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এ কাজটির জন্য গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন মুশফিক আরিফ। আমরা শুধু তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সাহস জুগিয়েছি, পরামর্শ দিয়েছি।’
হিমু এ প্রকল্পের জন্য যাঁরা প্রকাশ্যে বা গোপনে অর্থ দিয়ে এবং মেশিন কিনে দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের সবার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি হাসপাতালেই এ মেশিন পৌঁছানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে সারা দেশে তা পৌঁছাতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের সাধারণ জনগণ এগিয়ে এলে স্থানীয় অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
এ সময় মুশফিক আরিফসহ ‘আমাদের জন্য আমরা’ উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে এবং যাঁরা অর্থ ও মেশিন দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান জেলা প্রশাসক।