কীসের করোনা, কীসের কী, প্রশিক্ষণ চলছে দিব্যি
দেশে দিনকে দিন বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির সংখ্যা। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে লোকজনকে যথাসম্ভব বাসায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণী বিতান, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও তাদের অধীন পরিচালিত চলমান ও আসন্ন সব প্রশিক্ষণ কোর্স স্থগিত করেছে।
কিন্তু সরকারের এসব বিধিনিষেধ এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেই রাজধানী ঢাকায় চলছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের দুই মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কোর্স। এরই মধ্যে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ১০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে উপসর্গ নিয়েও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তবু থেমে নেই প্রশিক্ষণ কোর্স।
বিধিনিষেধের মধ্যে এই প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির (বাপশিস) পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে রাজধানীর টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে দুইমাস ব্যাপী এ প্রশিক্ষণ চলছে। গত জুন মাস থেকে শুরু হওয়া এ কোর্সে সারা দেশের ২০০ জন শিক্ষক অংশ নিয়েছেন। এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষকদের দলবদ্ধভাবে ব্যাবহারিক কাজ ও জব রিপোর্ট করতে হচ্ছে। ফলে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না। সার্বক্ষণিক যথোপযুক্ত পিপিই পরে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, কঠোর বিধিনিষেধে তেজগাঁও এলাকার সব কিছু বন্ধ রয়েছে। তেমনি ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রধান গেটও বন্ধ। কিন্তু পেছনের গেট খোলা। ওই গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা যায়, অর্ধশতাধিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ক্লাস করছেন। সেখানে পাশাপাশি বসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষকেরা ক্লাস করছেন। কেউবা ব্যাবহারিক করছেন।
প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর ভয় মাথায় নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমাদের তো কিছু করার নেই। নির্দেশ পালন করতে আমরা বাধ্য। চাকরি করতে হলে ট্রেনিংয়ে অংশ নিতেই হবে।’
নওগাঁ জেলা থেকে অংশ নেওয়া এক প্রশিক্ষক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা অনেক উদ্বেগের মধ্যে এখানে আছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে আমরা এখানে আছি। আমাদের তো কিছু করার নেই।’
এ বিষয়ে প্রশিক্ষক ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ কাজী জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি বিষয় না। এখানে যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, সবাই এখানে অবস্থান করেন। আমরা আমাদের ঘরে বসে খাওয়া-দাওয়া করি। এখানে যারা প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন তারা বাইরে যান না। সরকারের নির্দেশে এ প্রশিক্ষণ চলছে।’
অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘রাস্তার মধ্যে মানুষ চলাফেরা করছে। অনেক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামও আছে। সব কিছু তো বন্ধ নেই। জরুরি প্রয়োজনে তো অনেকে আছেন।’
এখানে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে কতজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী জাকির হোসেন বলেন, ‘আট-দশজন আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া এক শিক্ষক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গাদাগাদি করে চেয়ারে বসেই ক্লাস করছি। স্বাস্থ্যবিধির কোনো কিছুই মেনে চলা হচ্ছে না। দেশের চলমান এই পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণরত আমরা শিক্ষকগণ ও আমাদের পরিবারবর্গ প্রতিনিয়ত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। করোনা ও এর উপসর্গ থাকায় এ পর্যন্ত ২০ জনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ১৮০ জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।’
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আমান উল্ল্যাহ খান ইউসুফজী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বরাবরে গত ৩০ জুন আমরা শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখতে চিঠি দিয়েছি। এ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
সভাপতি জানান, গত জুন মাস থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে চলবে জুলাই মাসব্যাপী। এটি বিষয়ভিত্তিক ব্যাবহারিক প্রশিক্ষণ কোর্স।
সচিব বরাবর পাঠানো আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশের সব অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু কারিগরি শিক্ষকদের চলমান প্রশিক্ষণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ প্রশিক্ষণে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক প্রশিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ স্থগিত রাখা দরকার। এ পর্যায়ে প্রশিক্ষণার্থীদের পরিবার-পরিজন অনেক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খানকে এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে একাধিকবার টেলিফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
করোনাভাইরাসের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘এ ধরনের গোপন কোনো প্রশিক্ষণ চলছে কিনা তা আমাদের জানা নেই।’