গত বছর দেশজুড়ে ১১১৭ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার
শিশু সুরক্ষায় একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠনের সুপারিশসহ কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধের দাবি জানিয়েছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। আজ রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশ করে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে ২০২১ সালে বছরব্যাপী সারা দেশে কন্যাশিশু নির্যাতন নিয়ে জরিপ প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে জরিপ করেন তারা। যৌন হয়রানি ও নির্যাতন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সারাদেশে এক হাজার ১১৭টি কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৭২৩ জন ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ১৫৫ জন। এ ছাড়া ২০০ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
এর আগে ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬২৬ জন। এ হিসেবে এক বছরে দেশে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার বেড়েছে ৭৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২১ সালে ১১৬টি কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন বিশেষ শিশুও রয়েছে।
২০২০ সালে যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয় ১০৪টি শিশু। গত বছরের তুলনায় এ বছর যৌন হয়রানি বৃদ্ধির হার প্রায় ১২ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২১ সালে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৫২ জন কন্যাশিশু।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতিদিন সহস্রাধিক কন্যাশিশু পর্নোগ্রাফি ও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। এর মধ্যে গড়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন ভুক্তভোগী সাইবার হয়রানি সম্পর্কিত অভিযোগ কেন্দ্রে মৌখিক ও লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করে। প্রতিদিন ৩০টি অভিযোগ দাখিল হলে মাসে আনুমানিক ৯০০ অভিযোগ জমা হয় বলে ধরে নেওয়া যায়।
এসিড নিক্ষেপ সম্পর্কে জানানো হয়, ২০২১ সালে দেশে ১০টি কন্যাশিশু এসিড আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ২০৬টি কন্যাশিশু।
বাল্যবিবাহ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে দুই হাজার ৮৬৮টি কন্যাশিশু। গড়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ২১ জন কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি।
এ সময় ৮৭ জন কন্যাশিশুকে বাল্যবিবাহ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া এক বছরে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৭টি কন্যাশিশু, এর মধ্যে যৌতুক দিতে না পারায় ৯টি কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২১ সালে ২৪২ জন কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। প্রেমে প্রতারণার শিকার হয়ে ৬১ জন ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে ৫৬ জন কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া ২০২১ সালে ২৭২ জন কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন দৈনিক পত্রিকা থেকে ছয় থেকে ১৯ বছর বয়সের কন্যাশিশুদের প্রতি নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৩টি ক্যাটাগরির আওতায় ৫৬টি সাব-ক্যাটাগরিতে এসব তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ধর্ষণের বিচার সম্পর্কে বলা হয়, ২০২১ সালে ৮০৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা চালানোর অভিযোগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিভাবকেরা আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে, ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিচারের জন্য কেবল সাধারণ ডায়েরি (জিডি), মামলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অল্পসংখ্যক আটক করলেও পরবর্তীতে তারা অধিকাংশই জামিনে মুক্তি পেয়ে নির্যাতিত কন্যাশিশুসহ অভিভাবকদের বিভিন্ন রকম হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্ত শাস্তির কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
মাঠপর্যায়ে কন্যাশিশুদের বিভিন্ন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো, প্রতিদিন অনেক কন্যাশিশু সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। তাদের অনেকের জানা নেই কীভাবে, কোথায়, কার সহায়তায় এ বিষয়ে অভিযোগ করা যায় বা এর ফলাফল কী হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নাছিমা আক্তার জ্বলি, ব্র্যাকের জিজেডি অ্যান্ড পিভাউ পরিচালক নবনীতা চৌধুরী, গুডনেইবারস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাঈনুদ্দিন মাইনুল।
এ সময় বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সময়ে কন্যাশিশু নির্যাতনকারীরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রক্ষা পেয়ে যায়। এসব বন্ধ করতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে ১১টি সুপারিশ করা হয়-
১. শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সব ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।
২. উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নরোধে সর্বস্তরের জন্য ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ নামে একটি আইন জরুরিভিত্তিতে প্রণয়ন করতে হবে।
৩. ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা, মামলা ও ধর্ষণ সংশ্লিষ্ট সবধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে, ঘটনার শিকার কন্যাশিশু ও নারীর পরিবর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে ও আইনের আওতায় আনতে হবে। নারী ও শিশুকে অপদস্ত না করে অভিযুক্তের কাছে প্রমাণ চাইতে হবে যে, সে অপরাধী না। এ সম্পর্কিত প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করতে হবে।
৪. বর্তমান মহামারিতে বেশিরভাগ শিশুই ডিজিটাল ডিভাইসনির্ভর। তাদের সুরক্ষিত রাখতে ও সুস্থ মানসিক বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করতে উচ্চপর্যায়ের আইসিটি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় সবধরনের পর্নোগ্রাফিক সাইট বন্ধসহ পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
৫. কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
৬. শিশু সুরক্ষায় শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠন করতে হবে।
৭. করোনাকালে আর্থিক সংকটের কারণে অভিভাবকেরা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে, এর ফলে বাল্যবিবাহ বহুগুণে বেড়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বাজেট বাড়িয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কন্যাশিশু ও তাদের অভিভাবকদের এর আওতায় আনতে হবে।
৮. বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
৯. নির্যাতন বন্ধে বিদ্যমান আইনসমূহের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০. ক্রমবর্ধমান কন্যাশিশু ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষ, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, পরিবার সবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
১১. কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি সবধরনের সহিংসতারোধে তরুণ-যুবসমাজকে সচেতনকরণ সাপেক্ষে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত করতে হবে, একই সঙ্গে আইন ও বিচারিক কাঠামোয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে জেন্ডার সংবেদনশীল করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।