গ্রাম পুলিশের চাকরি জাতীয়করণে রায় স্থগিত
মহল্লাদারদের জাতীয় বেতন স্কেলের ২০তম গ্রেড এবং দফাদারদের ১৯তম গ্রেডে নির্ধারণ করে সারা দেশে দায়িত্বরত ৪৭ হাজার গ্রাম পুলিশের চাকরি জাতীয়করণ করতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
একইসঙ্গে হাইকোর্টের নির্দেশনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন (লিভ টু আপিল) শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন আপিল বিভাগ। পাশাপাশি আট সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্যও পক্ষদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ১৩ জুলাই দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল আবেদনের বিষয়ে শুনানি শেষে আজ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে গ্রাম পুলিশের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার কাওসার আহমেদ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস।
২০১৯ সালে রায় প্রকাশের পর পরই রাষ্ট্রপক্ষ গ্রাম পুলিশের বিষয়ে দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করে। সেটির শুনানি নিয়ে আজ এই আদেশ দিলেন আদালত।
এর আগে মহল্লাদার এবং দফাদারদের জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে রিট করেন ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ সদস্য। ওই রিটের শুনানি শেষে গ্রাম পুলিশের মধ্যে দফাদার পদধারীদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ২০০৯ সালে ঘোষিত জাতীয় বেতন স্কেলের (বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫) ১৯তম গ্রেড এবং মহল্লাদারদের ২০তম গ্রেডে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
২০১৯ সালের ১৫ ও ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে দায়িত্বরত ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশের করা এক রিট আবেদনে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে এমন রায় দেন আদালত।
যার লিখিত কপি (পূর্ণাঙ্গ রায়) পরে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ১৮ পৃষ্ঠার ওই পূর্ণাঙ্গ রায়ে গ্রাম পুলিশদের ২০১১ সালের ২ জুন থেকে সুবিধা দিতে বলা হয়েছে। সেই রায়ে ২০১১ সালের ২ জুনের পর স্থানীয় সরকার কর্মচারী চাকরি বিধিমালা-২০১১ বহির্ভূতভাবে গ্রাম পুলিশ পদে যেকোনো নিয়োগ অবৈধ ও বাতিল হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
হাইকোর্টের রায়টি বাস্তবায়ন করে ২০২০ সালের মার্চে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে সে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে।
সরকার ও গ্রাম পুলিশের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৯ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগ গ্রাম পুলিশ তথা দফাদার ও মহল্লাদারদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সমস্কেল প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই বছরের আগস্ট মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট সব কাগজাদি অর্থ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠায়। পরে স্থানীয় সরকার বিভাগ সব মহল্লাদার ও দফাদারদের ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারী গণ্য করে তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতির পদ্ধতি এবং তাদের বেতন-ভাতা জাতীয় বেতন স্কেল-২০০৯-এর আলোকে নির্ধারণ করে ২০১১ সালের ২ জুন একটি বিধিমালা জারি করে।
এ প্রসঙ্গে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) কর্মচারী চাকরি বিধিমালা, ২০১১ জারির মধ্য দিয়ে সব মহল্লাদার ও দফাদাররা ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারী হিসেবে গণ্য হয়ে জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত হন। কিন্তু ওই বিধিমালা কার্যকর না করে চার বছর পর গ্রাম বাহিনীর গঠন ও চাকরির শর্তাবলি বিষয়ে আরেকটি বিধিমালা জারি করা হয়। এই বিধিমালাটি কেন জারি করা হয়েছিল তা আদালতের কাছে বোধগম্য নয় বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। হাইকোর্ট বলেছেন,২০১১ সালের বিধিমালা কার্যকর না করে ২০১৫ সালের নতুন এই বিধিমালা প্রণয়ন বেআইনি ও এখতিয়ারবহির্ভূত।
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র নিজের আইন নিজে মেনে চলবে। রাষ্ট্র কখনো নিজের প্রণীত আইন ও বিধি ভঙ্গ করবে না। আইন সবার জন্য সমান। রাষ্ট্র ও নাগরিকের কোনো পার্থক্য নেই। আইন মোতাবেক চলা যেমনি নাগরিকের জন্য কর্তব্য তেমনি রাষ্ট্রের জন্যও তা সমভাবে প্রযোজ্য। এটাই আইনের শাসন। বর্তমান এই মামলায় গ্রাম পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের তাদের আইনত প্রাপ্যতা থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত করে আসছে।
রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ মোতাবেক আইনানুযায়ী ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে তথা ন্যায্য প্রাপ্যতা থেকে তথা ন্যায্য প্রত্যাশা থেকে তথা আইনসম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। এই রিট মামলায় গ্রাম পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ন্যায্য অধিকার হলো বিধিমালা ২০১১ অনুযায়ী বেতন ভাতাদি পাওয়া। কিন্তু তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বেআইনিভাবে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত করা হয়েছে। এতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, তাদের সঙ্গে বিবাদীরা আইনানুযায়ী আচরণ করেনি। বিবাদীদের এমন কর্ম ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।