চিকিৎসককে জরিমানা করা সেই ইউএনও ওএসডি
লকডাউনের মধ্যে রোগী দেখতে চেম্বারে যাওয়ার পথে ডা. ফরহাদ কবিরকে জরিমানা করা চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাঁকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। আর তাঁর স্থলে দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল বশিরুল ইসলাম।
আজ রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখা এর উপসচিব কে. এম. আল-আমীন এক সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেন।
বিষয়টি আজ বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আসার কথাটি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান। তিনি বলেন, ‘ইউএনও নজরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। একই প্রজ্ঞাপনে বদলিকৃত ইউএনও নজরুল ইসলামের স্থলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল বশিরুল ইসলামকে (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে পদায়ন করা হয়।
অভিযোগে প্রকাশ, রোগী দেখার জন্য চেম্বারে যাওয়ার পথে সাতকানিয়ার চিকিৎসক ফরহাদ কবির ইমারজেন্সি রোগী দেখতে চেম্বারে যাওয়ার পথে মোবাইল কোর্টে এই চিকিৎসককে এক হাজার টাকা জরিমানা করেন সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলাম । এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠে চিকিৎসক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান । বিষয়টি চুলে ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তিনি প্রতিকার কামনা করেন। পাশাপাশি স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে এ-সংক্রান্ত সংবাদও প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার মাত্র একদিনের মাথায় এই কর্মকর্তাকে সাতকানিয়া ছাড়তে হবে তিনি সাতকানিয়ায় এত তারিখে যোগদান করেছিলেন। ইউএনও নজরুল ইসলাম চলতি বছরের ২৩ মার্চ যোগদান করেছিলেন।
ডা. ফরহাদ কবির চট্টগ্রামের ইউএসটিসি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করেই গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়া এলাকায় চেম্বার গড়েন। পৌরসভার বেসরকারি আলফা হাসপাতালের পাশাপাশি নাছির ফার্মেসি ও মক্কা ফার্মেসিতে নিয়মিত রোগী দেখেন তিনি। ‘কঠোর লকডাউনে’র দ্বিতীয় দিন গত ২ জুলাই মক্কা ফার্মেসিতে চেম্বার করতে যাওয়ার পথে ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলামের চেকপোস্টে তল্লাশির মুখে পড়েন। মোটরসাইকেলে করে চেম্বারে যেতে থাকা ডা. ফরহাদকে সংকেত দিয়ে থামান ইউএনওর সঙ্গে থাকা লোকজন। এরপর মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নিয়ে ফরহাদকে ইউএনওর কাছে নেওয়া হয়। ইউএনও ডা. ফরহাদের পরিচয় জেনেও তাঁকে জরিমানা করেন।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী চিকিৎসক ডা. ফরহাদ কবির নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি লিখেন, ‘ধন্যবাদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার! লকডাউন অমান্য করে রুগি দেখতে চেম্বারে যাওয়াই ১০০০/- টাকা জরিমানা। সাথে ছবি তুলে নিয়েছে পত্রিকায় দেয়ার জন্য! নোটঃ আমার হেলমেট ছিল না বাইক চালানোর সময়।’
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. ফরহাদ কবির গণমাধ্যমকে বলেন, আমি গত শুক্রবার আসরের নামাজ শেষে মক্কা ফার্মেসিতে একজন রোগী আসার খবরে দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলাম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমি মোটরসাইকেলের হেলমেট, মানিব্যাগ ও পরিচয়পত্র নিতে ভুলে যাই। সাতকানিয়া কলেজের সামনে যেতেই ইউএনওর সঙ্গে থাকা লোকজন আমাকে থামানোর সংকেত দেন। আমি গিয়ে ইউএনওকে চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। ইউএনও শুরুতে লকডাউনে কেন বের হয়েছেন জানতে চেয়ে আমাকে পরিচয়পত্র দেখাতে বলেন। জবাবে আমি বলেছি পরিচয়পত্র আমার সঙ্গে নেই। তাহলে বের হয়েছেন কেন জানতে চাইলে আমি বলি—আমরা তো বিধিনিষেধের আওতামুক্ত। তাছাড়া আমরা বের না হলে রোগীদের চিকিৎসা দেবেন কে? এ কথা বলার পর তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘এতো কথা বলেন কেন? আপনাকে চাইলে আমি জেলে পাঠাতে পারি। কিন্তু আপনাকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হলো’।
এদিকে মানিব্যাগ বাসায় ফেলে আসায় আমার পকেটে এক হাজার টাকার বেশি ছিল না। বিষয়টি জানালে ইউএনও বলেন, ‘ঠিক আছে তাহলে এক হাজার টাকা জরিমানা দেন’।
ডা. ফরহাদ কবির আরও বলেন, ‘জরিমানা ধার্যের পর ইউএনও আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, তাতেই সবচেয়ে বেশি অপমানবোধ করেছি। তিনি আমাকে মাস্ক নামাতে বলেন। আমার ছবি তুলে নাকি পত্রিকায় দিতে হবে, যেন লোকজন জানে, চিকিৎসককে জরিমানা করা হয়েছে। এরপর কয়েকজন সাংবাদিক এসে আমার ছবি তুললেন। তাছাড়া ইউএনও মামলার কাগজ লেখার সময় বলেন, ডা. ফরহাদ কবির লিখতে বলেন, যেন লোকজন জানতে পারে চিকিৎসককে জরিমানা করা হচ্ছে।’
ঘটনার বিষয়ে ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার দিন ওই চিকিৎসকের মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স, হেলমেট কিছুই ছিল না। তাছাড়া তাঁর পরিচয়পত্রও ছিল না। তাঁকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি নিজেই ভুল স্বীকার করে জরিমানা করতে বলেন। পরে তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’
অবশ্য ইউএনও ডা. ফরহাদ কবিরের মোটরসাইকেলের হেলমেট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার বিষয় বললেও জরিমানার কাগজে অপরাধ দেখানো হয়েছে— দণ্ডবিধির ২৭০ ও ২৭১ ধারায়।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইন অনুযায়ী ২৭০ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো বিদ্বেষমূলক কার্য করে, যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোনো রোগের সংক্রমণ বিস্তার করতে পারে এবং সে কার্য করার দরুণ যে অনুরূপ রোগের সংক্রমণ বিস্তার হতে পারে তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ সত্ত্বেও তা করে, তবে সে ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’
২৭১ ধারায় উল্লেখ করা হয়, ‘কোনো জাহাজ বা জলযানের ওপর কোয়ারেন্টিন আরোপের জন্য অথবা যেসব জলযানের ওপর কোয়ারেন্টিন আরোপ করা হয়েছে, অপর কোনো জাহাজের বা তীরভূমির সঙ্গে তাদের সংযোগ সম্পর্কে, অথবা যেসব স্থানে সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ দেখা দিয়েছে, সেসব স্থানের সঙ্গে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ সম্পর্কে, সরকার দ্বারা প্রণীত ও জারিকৃত কোনো বিধি বা নিয়ম কোনো ব্যক্তি যদি জ্ঞাতসারে অমান্য করে, তবে সে ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থদণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গত ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। এ সময় জরুরিসেবা দেওয়া দপ্তর-সংস্থা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস, যন্ত্রচালিত যানবাহন, শপিংমল-দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছে। চিকিৎসক, গণমাধ্যমকর্মীসহ জরুরিসেবা-সংশ্লিষ্টরা এ বিধিনিষেধের আওতামুক্ত।