‘ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় কীভাবে থাকব’
ঝালকাঠি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে শেখেরহাট ইউনিয়নের শিরজুগ গ্রামে নিহত সংবাদকর্মী আহসান কবির খানের গ্রামের বাড়ি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়িচাপায় তাঁর মৃত্যুর পর দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ আর বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্ত্রী নাদিরা পারভীন রেখা।
গতকাল শনিবার দুপুরে আহসান কবির খানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আত্মীয় স্বজনরা কবর জিয়ারত করছেন। ঘরের ভেতরে শোকার্ত বাবা আবদুল মান্নান খান, মা আমেনা বেগম, স্ত্রী নাদিরা পারভীন রেখা, ছেলে সাদমান শাহরিয়ার কাইফ ও মেয়ে সাফরিন কবির দিয়া বসে বিলাপ করছেন। বাড়ির সামনেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাঁর লাশ।
আহসান কবির খানের স্ত্রী নাদিরা পারভীন রেখা বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ঢাকার মগবাজারের সোনালীবাগ চান বেকারী গলির বাসায় একসঙ্গে পরিবারের সবাই নাস্তা করি। কোনো একটি গার্মেন্টে মালামাল দেওয়ার কথা ছিল। এটা দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার ব্যস্ততা ছিল। ছেলেমেয়ে অঙ্ক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের ভালো করে পড়ালেখার পরামর্শ দিয়ে বাসা থেকে বের হয়। শুনেছি মালামাল কিনে মিরপুরের দিকে যাওয়ার সময় সিটি করপোরেশেনের ময়লার ট্রাকের চাপায় তাঁর মৃত্যু হয়।
নাদিরা পারভীন রেখা আরও বলেন, আমার স্বামীর জমানো কোনো অর্থ নেই। গামেন্টসের বিভিন্ন মালামাল সরবরাহের পেছনে তাঁর কিছু টাকা বিনিয়োগ করা। কিন্তু এ টাকা কোথায় আছে, আমি তা জানি না। পত্রিকায় চাকরি আর ব্যবসার টাকায় আমাদের দুটি সংসার ও ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচ চলত। তাঁর মৃত্যুতে আমরা শূন্য হয়ে পড়েছি। ছেলে ও মেয়ের পড়ালেখার জন্য আমাকে ঢাকায় থাকতে হবে। মালিবাগ ফয়জুর রহমান আইডিয়াল স্কুলে ছেলে নবম শ্রেণিতে এবং মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওদের রিকশায় স্কুলে নিয়ে যেত কবির। আমি গিয়ে আনতাম। এখন আর বাবার সঙ্গে স্কুলে যাওয়া হবে না ছেলেমেয়ের। আমি এখনও জানি না কীভাবে আমাদের সংসার চলবে। একটি মৃত্যু যেন পরিবারের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ছেলেকে বুয়েটে পড়ানো এবং মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন যেন অধরাই রয়ে গেল তার।
নাদিরা পারভীন রেখা আরও বলেন, আমি বিএ পাস করেছি, কিন্তু চাকরি করি না। এখন আমার একটি চাকরি প্রয়োজন। অন্তত সন্তানের পড়ালেখা ও বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির সংসার চালানোর জন্য। ঢাকা উত্তর সিটি করপরেশনের মেয়রের পক্ষ থেকে একজন উপসচিব (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তিনি আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমি পড়ালেখা জানি, তাই আমাকে যেন সিটি করপোরেশনে একটি চাকরি দেওয়া হয়। তা নাহলে আমাদের বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে।
নিহত কবীরের ছেলে সাদমান শাহরিয়ার কাইফ বলে, বাবা আমাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। বুয়েটে পড়ে একদিন আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো, আমার বোন ডাক্তার হবে। কিন্তু আমাদের সে স্বপ্ন এখন স্বপ্নই রয়ে গেল। বাবা নেই, এখন পড়া লেখার খরচ কে বহন করবে, তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। আমার মায়ের কোনো চাকরি নেই, আমরা এখন অসহায় হয়ে পড়েছি।
নিহতের ছোট ভাই এ কে এম আসাদুজ্জামান বলেন, আমার ভাই গ্রামে এলে তাঁর কাছে ছুটে আসতেন এলাকার মানুষ। তিনি সবার সঙ্গে নম্রভদ্রভাবে কথা বলতেন, মানুষকে ভালোবাসতেন। প্রয়োজনে কাউকে সহযোগিতা করতেন। ভাবিকে তিনি চাকরি করাননি। কখনো ব্যবসার কাজও শিখাননি। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি এখন দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁর একটি চাকরির প্রয়োজন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও ঢাকা উত্তর সিটির মেয়রের কাছে ভাবির একটি চাকরির দাবি করছি।
নিহত কবীরের বাবা আবদুল মান্নান খান বলেন, সিটি করপোরেশনের গাড়ি সাবধানে চালানো উচিত ছিল। একদিন আগে নটর ডেমের ছাত্র মারা গেল, এর পরও তাদের শিক্ষা হয়নি। আমার বড় ছেলেটাকেও ওরা মেরে ফেলল। আমি ওই চালকের বিচার দাবি করছি। আমার ছেলে কোনো মাসে ১০ হাজার কোনো মাসে এর চেয়েও বেশি টাকা পাঠাত। এখন আমি কীভাবে চলব? আমাদের সংসার কে চালাবে?
আজ রোববার বাদ আছর কবীরের আত্মার মাগফিরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। এর পর কবীরের স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে চলে যাবেন ঢাকায়।