জনসিনার দাম উঠেছিল ১০ লাখ, পরে ৫ লাখে বিক্রি!
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার মো. বোরহান একটি গরু নিয়ে রাজধানীর গাবতলীর হাটে এসেছিলেন। এই হাটে বোরহানের ‘কিশোরগঞ্জের জনসিনা’ই ছিল অন্যতম বড় গরু। ফ্রিজিয়ান জাতের গরুটির ওজন ৪০ মণ। উচ্চতা পাঁচ ফুট ১০ ইঞ্চি। লম্বায় ১০ ফুট। বোরহান গরুর হাটে আসেন গত শুক্রবার। তিনি ৩৫ লাখ টাকা থেকে দাম হাঁকানো শুরু করেন। তিনদিন অপেক্ষার পর গতকাল মঙ্গলবার রাতে সেই গরু মাত্র পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন বোরহান!
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, তাহলে কীসের ওপর ভিত্তি করে বোরহান তাঁর গরুর এত উচ্চমূল্য হাঁকিয়েছিলেন? আর কীসের কারণেই বা তিনি এত কমমূল্যে সেটি বিক্রি করে দিলেন?
বোরহানের ‘কিশোরগঞ্জের জনসিনা’র পাশেই ছিল চাঁদপুরের নজরুল ইসলামের গরু ‘কালা মানিক’। মালিকের দাবি, গরুটির ওজন ৩৫ মণ। তিনি ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকালেও আট-নয় লাখ টাকা হলেই বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু তিন দিন অপেক্ষা করেও কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে গরু নিয়ে কচুয়া উপজেলার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন।
আজ বুধবার ঈদুল আজহার দিন বিকেলে নজরুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার গরু তো মেডিসিন দিয়ে বড় করা না। সেজন্য গরুর বাঁচা-মরা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। সেজন্য আমি বাড়ি নিয়ে ফিরেছি। আর আমার পাশে থাকা বোরহান, তাঁর জনসিনা গরু পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। কারণ, উনি ওষুধ খাইয়ে খাইয়ে গরুটি বড় করেছেন। বাড়ি নিয়ে যেতে যেতেও গরুটি মারা যেতে পারত। সুতরাং যেকোনোভাবে তাঁর গরুটি বিক্রি করতে হবে। উনি তাই করেছেন। পাঁচ লাখ টাকাই উনার লাভ।’
বিকেলে ‘কিশোরগঞ্জের জনসিনার’ মালিক এ ব্যাপারে বলেন, ‘ভাই, আমার অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমি বিক্রি করে দিয়ে এসেছি। কারণ, বাড়ি থেকে একবার যখন গরুটি বের করেছি, এটা বাড়ি আনতে আনতে মরেও যেতে পারত। হাটে তিন দিন থেকে গরুটি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। গরুটির দাম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু আমি দিইনি। যাক, সেসব কথা আর মনে করতে চাই না।’
গাবতলীর হাটে ‘কিশোরগঞ্জের জনসিনা’ কিনতে চেয়েছিলেন ঢাকার ব্যবসায়ী সৈকত হুসাইন। তাঁর দাবি, তিনি গরুটির সর্বোচ্চ দাম ১০ লাখ টাকা বলেছিলেন। কিন্তু মালিক দেননি। গত রোববার তিনি এনটিভি অনলাইনকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘কোরবানির জন্য গরু ব্যবসায়ীরা যেন ডাকাতি করতে বসেন। মনে হয়, টাকা আয় করতে হয় না। রাস্তাঘাটে পাওয়া যায়।’
আজ বুধবার বিকেলে এই প্রতিবেদক আবার যোগাযোগ করেন ব্যবসায়ী সৈকত হুসাইনের সঙ্গে। তাঁকে জানানো হয়, ‘কিশোরগঞ্জের জনসিনা’ সবশেষ পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন মালিক। এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সৈকত হুসাইন বলেন, ‘দেখেন, আমি ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বলেছিলাম। অথচ, বিক্রি করতে হলো পাঁচ লাখ টাকায়। এটাই আল্লাহর বিচার। কোথায় ৩৫ লাখ, আর কোথায় পাঁচ লাখ!’
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘কোরবানির পশু কেউ কেজিদরে মাংসের হিসাব করে কিনে না। মানুষ তাঁর সাধ্যের সবটুকু দিয়েই সুন্দর দেখে মনের মতো পশু কেনে। একবার ভেবে দেখেছেন, ৪০ মণ গরুর দাম যদি ৩৫ লাখ চাওয়া হয়- তাহলে কেজি কত করে হলো? দুই হাজার ১৮৭ টাকা করে। এটা কারো পক্ষে কেনা সম্ভব? দাম চাইলেই তো হবে না! আর এখন পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। তাহলে দাম হয়েছে ৩১৩ টাকা কেজি। এটা বা আরেকটু বেশি সামঞ্জস্যের মধ্যে।’
ব্যবসায়ী সৈকত হুসাইনের মতে, ‘এটা কোরবানি দিতে চাওয়া মানুষের সঙ্গে জুলুম করা। এটা অন্যায়। আর বেশি লাভের ফল তো দেখলেন, শেষে গরুই বিক্রি হলো না।’
গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই মূলত পশুর হাটের দৃশ্য পাল্টাতে থাকে। কোরবানির পশুর দাম কমতে থাকে। বড় গরুর চেয়ে ছোট আর মাঝারি আকারের গরুর প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষণ বেশি দেখা যায়। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা গরু আরও বেশি দামের আশায় আটকে রেখেছিলেন তাদের মাথায় হাত পড়ে। সুযোগ বুঝে ক্রেতারাও কম দাম বলতে থাকেন।
আজ বুধবারও গাবতলী ও আফতাবনগর পশুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা গরু নিয়ে বসে আছেন। হাটেই তাঁরা ঈদ করেছেন। কিন্তু তাদের চোখে-মুখে আনন্দের চিহ্নমাত্র নেই, বিষাদের ছায়া। ব্যবসায়ীদের দাবি, এই মন্দা তাদেরকে অনেকদিনের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। করোনার সময়ে এই ক্ষতি তাদের পক্ষে কাটিয়ে উঠা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আনন্দ নিয়ে বাড়ি থেকে গরু নিয়ে এলেও হাট ছাড়তে হচ্ছে তাদের চোখের জলে।
আফতাবনগর হাটে আসা গরু ব্যবসায়ী হাফিজ সরদার ক্ষোভ আর কষ্ট নিয়ে বুধবার বিকেলে বলেছিলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে আফতাবনগরে গরু নিয়ে আসি আমি। কিন্তু, কখনো এমন বাজে হাট দেখিনি।’
গরুর দামের বিষয়টি নিয়ে অন্তত ৫০ জন ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে কয়েকজন বিক্রেতা জানিয়েছেন, ঈদের সময় কেজিপ্রতি মাংসের হিসাব করে কখনও দরদাম ঠিক হয় না। অন্যান্য সময়ের হিসাব আলাদা।
গরুর ক্রেতা শাহীন আলী গতকাল মঙ্গলবার গাবতলীর হাটে এ ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘আমি এর আগেও তিনদিন হাটে এসেছি। আজও এসেছি। আজ দেখছেন কেমন হাহাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে? এটা কেন হয়েছে? তাদের অতিরিক্ত দাম চাওয়ার জন্যই। নিজেদের সাজা নিজেরাই দিয়েছেন।’
আজ দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মাহমুদ রাকিব গাবতলীর পশুর হাটে গরু কিনতে যান। তিনি একটি গরুর দরদাম করেন। গরু ব্যবসায়ী রওশনের দাবি, গরুটির ওজন এক টন বা এক হাজার কেজি। তিনি গরুর দাম চেয়েছেন ১১ লাখ টাকা। দাম শুনে রাকিব মাহমুদ বলে ফেলেন, ‘এক হাজার ১০০ টাকা কেজি দরে গরু কিনতে হবে? যেখানে বাজারে বেশি হলে ৫৫০ টাকা কেজিপ্রতি গরুর মাংসের দাম।’
যদিও রওশনের দাবি, ‘গরুটি যখন বাড়িতে ছিল, তখনই একজন ১০ লাখ টাকায় কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা দিইনি।’
ঈদের দিন বিকেল পর্যন্ত রওশনের গরুটি বিক্রি হয়নি। গরুটির দাম ওঠে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত।
মঙ্গলবার আফতাবনগরের পশুর হাটে পাবনার গরু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ মুনসুর শেখ কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘আসলে কেজিপ্রতি হিসাব করে কোরবানির হাট চলে না। তবে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এত বেশি দাম হাঁকান, যাতে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ীর ক্ষতি হয়। যেমন এবার হলো। প্রথমে এত বেশি দাম ছিল যে, ক্রেতা কিনতেই সাহস পায়নি।’
আল-আমিন নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘আমার একটি গরু ছিল ১৫ মণ ওজন। আমি দাম চেয়েছিলাম মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। সে সময় আমার ক্রেতা বলছিলেন, আপনি এত কম চান কেন? এর চেয়ে ছোট ছোট গরুর দামও তো অনেক বেশি চায় লোকে। পরে আমি তাদের কাছেই প্রায় চার লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। আমারও আরও কয়েকটি গরুতে কিছু টাকা লোকসান হলেও ওই গরুতে কিন্তু লোকসান হয়নি।’