জীবনের শেষ লগ্নে ঘর পেলেন বীরাঙ্গনা চারুবালা
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হন চারুবালার স্বামী চন্দ্রকান্ত বিশ্বাস। সেই দিনই হানাদার বাহিনীর হাতে সন্তান ও সম্ভ্রম হারায় ফরিদপুর বাসিন্দা চারুবালা। এরপর শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা বাজারে শাকসবজি বিক্রি করে কোনোরকম দিন কাটান ওই নারী। একটি থাকার ভালো ঘরও ছিল না চারুবালার। সেই বীরঙ্গনা চারুবালাকে ঘর বানিয়ে দিলেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) আলিমুজ্জামান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চারুবালা পদ্মানদী থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে দুর্গম বালুচর ও ফসলি মাঠের জমির মধ্যে তাঁর ভাই সিদ্ধিচরণ সরকারের আশ্রয়ে থাকতেন। যে ঘরে তিনি থাকতেন তা ছিল ছনবন আর পাটখড়ি দিয়ে গড়া একটি ভাঙা ঘর।
ফরিদপুর জেলা শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি শেখ সাজ্জাদুল হক সাজ্জাত জানায়, মুক্তিযুদ্ধে হানাদাররা চারুবালার স্বামী ও শিশুসন্তানকে মেরে ফেলে। তাঁকে ধর্ষণ করে ও বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে ওই দুর্গম চরাঞ্চলে বীরাঙ্গনা চারুবালা একা একা জীবনের ৫০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধে স্বামী, সন্তান ও সম্ভ্রম হারানো চারুবালার বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির জন্য ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার একটি প্রস্তাবনা সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
চারুবালা বলেন, ‘৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন আমার স্বামী চন্দ্রচরণ বিশ্বাসকে গুলি করে মারে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। আমার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে দুই বছরের শিশু পার্বতীকে উঠানের ওপর আছড়ে মেরে ফেলে। পরে আমাকে নির্যাতন করে ও সম্ভ্রমহানি ঘটায়। সেই দিনের সেই করুণ দৃশ্য আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না।’
এমন বীরাঙ্গনা মা চারুবালার থাকার জন্য কোনো ঘর নেই। ফরিদপুর জেলার শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির মাধ্যমে এমন খবর পান পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান। এরপর পুলিশের বেতন থেকে একটি সেমিপাকা টিনের ঘর করার ব্যবস্থা করেন তিনি। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়নের পদ্মানদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল রমেশবালা গ্রামে নির্মিত ওই ঘরটি রোববার (২ মে) বিকেল হস্তান্তর করেন ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।
ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামানের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, ‘এই করোনাকালে পুলিশ সদস্যদের বেতনের টাকা থেকে এমন একজন মানুষকে ঘর করে দেওয়া হলো। বিষয়টি সত্যি প্রশংসার যোগ্য।’
এ সময় মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন চারুবালাকে নগদ এক লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য দেন।
পুলিশ সুপার মো. আলীমুজ্জামান বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সদস্য এবং বীরাঙ্গনা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে আমি ও আমার সহকর্মীরা গর্বিত। ভবিষ্যতে তাঁর সহায়তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হবে পুলিশের পক্ষ থেকে।’
পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘আমি যখন জেলা শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির কাছ থেকে শুনতে পাই তাঁর কোনো ঘর নেই। তখনই ওই উপজেলায় কর্মরত ওসিকে দিয়ে তাঁর বাড়িতে খাবার এবং টাকা পাঠাই। এরপর সিদ্ধান্ত নেই, তাঁর জন্য একটি থাকার ঘর করে দিব। পরে আমাদের পুলিশ সদস্যদের বেতনের টাকা থেকে একটি সেমিপাকা ঘর করে দিই।’
এসপি জানান, শহীদ পরিবারের সদস্য এবং বীরাঙ্গনা অসহায় পরিবারের জন্য পুলিশের দ্বার সব সময় খোলা থাকবে।
এদিকে, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জীর্ণশীর্ণ ঘরে থাকা বীরঙ্গনা নারী চারুবালাকে ঘর দেওয়ায় ফরিদপুরের এসপি আলিমুজ্জামানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ফরিদপুরবাসী। তারা পুলিশ সুপারের মহতি এমন উদ্যোগকে এক অনন্য নজীর হিসেবে তুলনা করেছেন। মহান মানুষ হিসেবে তুলনা করে ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন চারুবালা নিজেও।