তারা পুলিশের টোকেন নিয়ে লাইনে থাকে, ভাড়ায় টিকেটও কাটে!
কমলাপুর রেলস্টেশনের দ্বিতীয়তলায় ঢাকা রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়। দ্বিতীয়তলায় ওঠার সিঁড়িতে বসেছিলেন কয়েকজন। তারা ট্রেনের টিকেটের টোকেন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। অন্য একজনের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে টিকেট কেটে দেওয়ার কথা বলছিলেন।
পাশে বসে সব আলোচনা শুনছিলেন আকাশ চৌধুরী। আকাশ স্টেশনে যান ট্রেনের টিকেট কাটতে। কিন্তু, আজ সোমবারে দেওয়া ২৯ এপ্রিলের দিনাজপুরের অগ্রিম টিকেট শেষ। ফলে, টিকেট কাটতে হলে আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাঁকে। আকাশ চৌধুরী ভাবতে থাকেন, তাদের (কিশোর-যুবক) কাছে টিকেট কেটে দেওয়ার কথা জানাবেন।
আকাশ চৌধুরী তাদের দ্রুতযান এক্সপ্রেসের টিকেট কেটে দেওয়ার কথা জানান। ওখানে পাঁচ কিশোর-যুবক ছিলেন। আশপাশে তাদের দলের আরও অনেকে ছিলেন। তাদের মধ্যে থেকে হৃদয় নামের একজন আকাশের কাছে জানতে চান, কতটি টিকেট লাগবে। আকাশ চারটি টিকেটের কথা জানালেন। তখন হৃদয় আকাশকে জানালেন, তাঁকে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা দিলে ৩০ এপ্রিলের চারটি টিকেট কেটে দেবেন তিনি।
টিকেটের টোকেন কীভাবে সংগ্রহ করা হবে, তা জানতে চান আকাশ চৌধুরী। তখন হৃদয় বলতে থাকেন, ‘আমার কাছে কমলাপুর রেলওয়ে থানার টোকেন আছে। এগুলো সব পুলিশের টিকেট।’ হৃদয়ের দাবি, সব কাউন্টার থেকেই পুলিশের ‘থানা’ লেখা টোকেন দিয়ে কাল সকালেই টিকেট সংগ্রহ করা হবে। তারপর সেই টিকেট পুলিশকে দিয়ে দেওয়া হবে। টোকেন প্রতি অন্তত ৫০০ টাকা পুলিশের কাছ থেকে নেবেন বলেও দাবি করেন হৃদয়।
আকাশকে উদ্দেশ্য করে হৃদয় বলতে থাকেন, ‘আমি টোকেন নিয়ে রাখব। লাইনে দাঁড়াব। আপনি শুধু আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে লাইনে এসে দাঁড়াবেন ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে এসে। আমার কাছে তো টিকেট দেবে না। যারা টিকেট দেবে, তারা আমাদের চেনে। আপনার সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি শুধু আমাকে দুই হাজার টাকা দিবেন। আপনার কোনো কষ্ট করতে হবে না। সকাল ৮টার সময় টিকেট দেওয়া শুরু হবে।’
এসব আলোচনা যখন চলছিল, তখন এ প্রতিবেদক পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। প্রতিবেদকও টোকেন কেটে টিকেট পাইয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন হৃদয়কে। কিন্তু, কীভাবে টোকেনের ব্যবস্থা করা হয়, তা জানতে চান। তখন হৃদয় এ প্রতিবেদককে দুটি টোকেন দেখান। দুটি টোকেনেই ‘থানা’ লেখা। টোকেনের উল্টার পিঠে ‘ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’র (ওসি) সিল মারা! হৃদয় বলতে থাকেন, ‘থানা পুলিশের টোকেন যদি আমার কাছে থাকে, আমি আপনার জন্য আরেকটি টোকেন ম্যানেজ করতে পারব না?’
হৃদয় প্রতিবেদককেও টিকেটপ্রত্যাশী ভেবে প্রতি টিকেটের জন্য ৫০০ টাকা অতিরিক্ত চান। তাহলে তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। প্রয়োজনে পুলিশের কথা বলে চাপ দিয়ে টোকেন নেবেন বলেও তিনি জানান। এসব কথা বলতে বলতে সেখানে কমলাপুর রেলওয়ে থানার বৃষ্টি নামের এক পুলিশ সদস্য হাজির হন। তিনি হাজির হওয়া মাত্রই সেখানে থাকা পাঁচজন স্যার বলে সম্বোধন করেন তাঁকে।
পরক্ষণেই বৃষ্টি তাদের কাছে জানতে চান টোকেন নিয়ে। তিনি বলেন, ‘কয়টা টোকেন আছে তোদের কাছে?’ মিনিট পাঁচেক বৃষ্টি কথা বলেন তাদের সঙ্গে। এরপর বৃষ্টি রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পর তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ওই পাঁচ জনের সঙ্গে কথা বলেন। তখন তিনি পুনরায় একটি সাদা কাগজের স্লিপ ধরিয়ে দেন হৃদয়কে। সেখানে ঢাকা-রংপুরের একটি ও ঢাকা দিনাজপুরের দ্রুতযান এক্সপ্রেসের একটি টিকেটের কথা লেখা ছিল। ওই কাগজেও ‘থানা’ শব্দটি যোগ করা ছিল।
সেখান থেকে রেলওয়ে থানার দিকে যাওয়ার সময় এ প্রতিবেদক বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করেন, তাদের কাছে টোকেন কেন দিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওরা তো থানার টিকেট কেটে দিতে বাধ্য। কারণ, ওরা আমাদের ডোম ঘরে কাজ করে। যেহেতু লাইনে দাঁড়িয়ে থানার লোকদের টিকেট কাটে, সেহেতু আমার একটা কাজটাও করে দিল। আমি প্রতি টিকেটের জন্য ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বকশিস দেব ওদের।’
বৃষ্টিকে জানানো হয়, আমার (এ প্রতিবেদক) কাছে চারটি টিকেটের জন্য অতিরিক্ত ২০০০ টাকা চেয়েছে হৃদয়। তখন বৃষ্টি বলেন, ‘মাইর দিতে পারতেন।’ যদিও এত কথা পাশে দাঁড়িয়ে শুনেছি, তার সঙ্গে কথা বলেছি কিন্তু বৃষ্টি জানেন না একজন গণমাধ্যমকর্মী তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন।
হৃদয় ৯ বছর বয়স থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকেন। কখনো রেললাইনের ধারে, কখনো ডোম ঘরে তিনি ঘুমান। কথা প্রসঙ্গে হৃদয় বলছিলেন, ‘আমি টোকেনের ব্যবস্থা করে দেব। সারা রাত জেগে থাকব। আমার লাভ না হলে আমি কেন এসব করব? আপনার চারটি টিকেট কেটে দেব, আপনি দুই হাজার টাকা দেবেন। শুধু আমি না, আরও অনেকেই এভাবে টোকেন দিয়ে টিকেট কেটে দিতে পারি। পুলিশের কাজ করি, টোকেনের ব্যবস্থা করে দিতে পারব না?’
হৃদয়ের সঙ্গে থাকা আরেকজন (নাম জানা যায়নি) এ প্রতিবেদককে বলতে থাকেন, ‘আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। বড় বড় স্যারেরা আছেন। তাদেরও খুশি করতে হয়। আবার মানুষও খুশি হয়। আমাদের কিছু লাভ হয়। এটা সেবার মতো।’
শুধু হৃদয় নয়, কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকা এমন অন্তত ৫ জনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। যারা টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় খাটেন। টোকেন সংগ্রহ করে দেন। লাইনে দাঁড়ান। টিকেট সংগ্রহ করা পর্যন্ত তারা কাজ করে দেন বলে সবাই দাবি করেছেন।
তাদের মধ্যে একজন শফিক হোসেন। তিনি বলেন, ‘কোনো সময় যাতে কেউ আমাদের না ধরে সেজন্য অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। আমার মতো অনেকেই আছে, এ কাজ করে। ভাড়া খাটে। সারা রাত জেগে থাকে। কষ্ট করে। মানুষেরও লাভ হয়। সারা রাত থাকতে হয় না স্টেশনে। ভোরে বা সকালের দিকে এলেই হয়। মধ্যে দিয়ে আমাদের কিছু লাভ হলো।’