দিশেহারা ভৈরবের পাদুকা ব্যবসায়ী-শ্রমিকরা
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি সম্ভাবনাময় ও টেকসই শিল্পের নাম পাদুকাশিল্প। রাজধানী ঢাকার পরেই ভৈরবের পাদুকার চাহিদা সারা দেশেই রয়েছে। ভৈরব এক সময় তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানকার গামছার কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের তাঁতশিল্পের বিপর্যয়ের ঢেউ ভৈরবেও লাগে। পর্যায়ক্রমে এখানকার তাঁতশিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কর্মহারা তাঁতশিল্পের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে তুলেন পাদুকাকারখানা।
ব্যবসায়ীদের মতে, উপজেলায় বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ছয় থেকে সাত হাজার পাদুকা কারখানা আছে। যারমধ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ রপ্তানিমুখী ৩৫টির মতো বড় পরিসরের কারখানা আছে। আর এসব কারখানায় এক লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। নারী শ্রমিক কাজ করেন ১৫ থেকে ২০ হাজার।
পাদুকার নানা উপকরণ বিক্রির ব্যবসাসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ছয়টির মতো বৃহত্তর পাইকারি মার্কেট এবং ৫০টিরও বেশি পাদুকাশিল্প পল্লী নিয়ে এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় কর্ম ও অর্থনৈতিক বলয়। যার উন্নতির সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও জড়িত বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
রমজান মাসে পাদুকা শিল্পের উৎপাদন ও বিক্রি নিয়ে সব চেয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন এখানকার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। পাদুকাশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা এই মৌসুমের আয় দিয়ে সারা বছর জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন তাদের কাছে। পাদুকার প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তারা চাহিদা মতো উৎপাদন করতে পারছেন না। ফলে হাতের পাইকার ধরে রাখতে পারছেন না তারা। আর ভরা মৌসুমে পাইকারের চাহিদা মতো সরবরাহ না দিতে পারলে, সেই বিমুখ পাইকারের কাছে আর বিক্রি করা যাবে না। আগের বকেয়াও আদায় করা যাবে না। শ্রমিকদের পাওনাও মেটানো যাবে না।
এই প্রসঙ্গে শহরের কমলপুর এলাকার কারখানামালিক আতাউর মিয়া বলেন ‘গত দদুই-তিন বছর করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ভৈরবের পাদুকাশিল্পেরও বিশাল ধস নামে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের মতো ছোট কারখানার মালিকরা। করোনাপরবর্তী এই মৌসুমে প্রচুর চাহিদা সত্ত্বেও বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ঠিক মতো উৎপাদন করতে পারছি না।’
মুসলিমের মোড় এলাকার কারখানামালিক সবুজ মিয়া বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে সব উপকরণের মূল্য ৮০ থেকে ১০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাজারে পাদুকার মূল্য তো বৃদ্ধি পায়নি সে অনুযায়ী। ফলে আমরা উৎপাদন ব্যয় আর বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েছি।’
জানতে চাইলে গোধূলি সিটি এলাকার কারখানা শ্রমিক বশির, ফুলমিয়া পাদুকাপল্লীর রমজান মিয়া এবং গাছতলাঘাট এলাকার ময়না ও রেশমা বেগম জানান, তাদের মজুরি দুই-তিন বছর আগে যেমনটি ছিল, এখনও তেমনটিই আছে। অথচ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। ফলে তাদের জীবনযাপন বড়ই কষ্টের হয়ে পড়েছে।
তাঁরা আরও জানান, একজন পুরুষ শ্রমিক গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পান। আর একজন নারী পান ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এই টাকায় বর্তমান বাজারদরে তিন-চারজন অথবা এর অধিক সদস্যের পরিবার কীভাবে চলতে পারে?
ভৈরব পাদুকা কারখানামালিক সববায় সমিতির সভাপতি মো. আলামিন মিয়া বলেন, ‘এ মুহূর্তে বাজার পরিস্থিতি ভালো নয়। বিশেষ করে চীন থেকে আমদানি করা পাদুকা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ যেমন-চামড়া, রেক্সিন, হিল, সুতা, ফোম, কভার, পেস্টিং, আঠার মূল্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পয়েছে। ফলে তার সরাসরি প্রভাব উৎপাদনের উপর পড়েছে। এতে পাদুকা কারখানার মালিক-শ্রমিকরা মহাসংকটে পড়েছেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ বলেন, ‘বিরূপ বৈশ্বিয়ক অবস্থার কারণে সব ক্ষেত্রেই মন্দাভাব পড়েছে। সেক্ষেত্রে পাদুকাশিল্পও বাদ যায়নি। যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পাদুকা কারখানার মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যাপারে কেউ যোগাযোগ করলে উপজেলা প্রসাশন সার্বিক সহযোগিতা করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।’
সরকারের সুষ্ঠু নজরধারী ও সময়োপযোগী যথাযথ পদক্ষেপে এখানকার এই বৃহৎ শিল্পের সংকট কেটে সোনালি আভায় উদ্ভাসিত হবে—এমনটিই প্রত্যাশা মালিক-শ্রমিক আর স্থানীয়দের।