দুদকে বাছিরের মতো এমন আরও আছে : ডিআইজি মিজান
ঘুষ লেনদেনের মামলায় বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান ও দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরকে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
আজ বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই রায় ঘোষণা করেন। এ রায় ঘোষণা শেষে ডিআইজি মিজান সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দুদকে বাছিরের মতো একজন না, আরও বাছির আছে। তাদের খুঁজে বের করুন। এনামুল বাছির তাকে ঘুষ দিতে বাধ্য করেছেন।’
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এনটিভি অনলাইনকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ডিআইজি মিজানকে একটি ধারায় তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অপরদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরখাস্ত হওয়া পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে পৃথক দুটি ধারায় পাঁচ বছর ও তিন বছর করে মোট আট বছরের কারাদণ্ড এবং ৮০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে বাছিরের দুটি ধারায় সাজা একসঙ্গে চলবে বলে তাঁকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে রায়ে বলেছেন বিচারক।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় কড়া পুলিশি প্রহরায় ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপরে তাদের আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে বিচারক এ মামলার রায় পড়া শুরু করেন। প্রায় ১ ঘণ্টা রায় পড়া শেষে আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন বিচারক।
এর আগে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ দুদকের করা মামলায় বিবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। একই বছরের ৪ মার্চ দুদকের পক্ষে অভিযোগ গঠন শুনানি শেষ হয়। ওই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই ৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে মিজান ও বাছিরের বিরুদ্ধে জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি করেছিলেন শেখ মো. ফানাফিল্যা। ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পর ডিআইজি মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে সরকার।
এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এনামুল বাছিরকে। ওই অনুসন্ধান চলমান অবস্থায় ওই বছরের ৯ জুন ডিআইজি মিজান অনুসন্ধান থেকে বাঁচতে এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে। এর পরপরই দুদকের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি খন্দকার এনামুল বাছিরের বক্তব্য গ্রহণ করে এবং পারিপার্শ্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পায়। এরপর একই বছরের ১৩ জুন পরিচালক ফানাফিল্লাহর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে।
অনুসন্ধান দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য গ্রহণ, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ ও পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ডিআইজি মিজানুর রহমান একটি বাজারের ব্যাগে করে কিছু বইসহ ২৫ লাখ টাকা খন্দকার এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রাজধানীর রমনা পার্কে আসেন। সেখানে কথাবার্তা শেষে একসঙ্গে বেরিয়ে শাহজাহানপুর এলাকায় যান। এরপর খন্দকার এনামুল বাছির ২৫ লাখ টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে তাঁর বাসার দিকে চলে যান। একইভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিআইজি মিজান একটি শপিং ব্যাগে করে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে রমনা পার্কে যান। সেখানে আলাপ-আলোচনা শেষে দুজন শান্তিনগর এলাকায় চলে যান। শান্তিনগর থেকে এনামুল বাছির ব্যাগটি নিয়ে চলে যান। দুদকের কাছে এ ঘটনার প্রযুক্তিগত প্রমাণের পাশাপাশি চাক্ষুষ সাক্ষীও রয়েছে।
পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে বলেন, আসামি ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান (সাময়িক বরখাস্ত) এর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত একটি অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের নথিমূলে অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। উক্ত অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর খন্দকার এনামুল বাছিরের নামে হাওলা করা হয়। তিনি ওই বছরের ২৯ অক্টোবর অনুসন্ধানভার গ্রহণ করেন। অনুসন্ধান চলমান থাকাবস্থায় ২০১৯ সালের ৯ জুন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এই মর্মে সংবাদ প্রচারিত হয়, যে ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত অনুসন্ধান সংশ্লেষে বিভিন্ন সময়ে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ প্রদান করেছেন। এ বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের গোচরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চপর্যায়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত তদন্ত কমিটি এনামুল বাছিরের বক্তব্য গ্রহণ করেন এবং পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে খন্দকার এনামুল হক বাছির কর্তৃক ডিআইজি মিজানুর রহমানের থেকে ঘুষ লেনদের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীকালে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। অনুসন্ধানের সময় প্রাথমিকভাবে সতত্য পাওয়ায় এ মামলা দায়ের করা হয়।
ডিআইজি মিজান ও এনামুল হক বাছির বিভিন্ন সময়ে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে এসএমএসএর মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাছিরের সঙ্গে ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথন রেকর্ড করে সংরক্ষণ করেছেন এবং পরবর্তীকালে গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
আরও জানা যায়, মামলার তদন্তকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বিশেষজ্ঞ মতামত, প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের বক্তব্য, অডিও রেকর্ডে উভয়ের কথোপকথন ও পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে প্রমাণিত হয় যে, ডিআইজি মিজান অভিযোগের দায় থেকে বাঁচার জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে উৎকোচ প্রদান করে খন্দকার এনামুল বাছিরকে প্রভাবিত করেছেন।
ডিআইজি মিজানুর ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুর দিকে তাঁকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। তিনি ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে কারাগারে আছেন।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম আজ রায়ের দিন ধার্য করেন। গত ২৪ জানুয়ারি যুক্তি উপস্থাপন শুনানি শেষে মিজান ও বাছিরের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।