‘নারীকে কুঁড়িতে ঝরে পড়া যাবে না, ফুটতেই হবে’
‘নারীর অধিকার নয়, সমতার সমাজ চাই, আর কর্মক্ষেত্রে নারীরা যেন বাধার সম্মুখীন হয়ে ঝরে না পড়ে, বসন্তের নতুন পাতার আর ফুলের মতো ফুঠে ওঠে’— আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এমন মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য তিলোত্তমা সিকদার। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, নারীদের সফলতাকে পোশাক আর লাল লিপস্টিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়।
তিলোত্তমা সিকদার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সদস্য।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারীর অগ্রগতিতে সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তিলোত্তমার সঙ্গে কথা বলে এনটিভি অনলাইন।
এনটিভি অনলাইন: আর্ন্তজাতিক নারী দিবস নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
তিলোত্তমা সিকদার : নারী দিবসে অবশ্যই আমাদের নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিশ্বে নারী কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এ বিষয় নিয়ে ভাবার সময়। বর্তমান বিশ্বে আমরা দেখছি যে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে সপ্তম স্থান অধিকার করেছে। তাই আমার মনে হয়, বর্তমান এ সময়ে এসে এখন আর আমাদের নারী দিবসকে আলাদাভাবে উদযাপনের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের নারীদের জন্য প্রতিটি দিনই এগিয়ে যাওয়ার দিন, নারীদের জন্য প্রতিটি দিনই স্বপ্ন পূরনের দিন বলে আমি মনে করি।
এনটিভি অনলাইন: নারীদের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন?
তিলোত্তমা সিকদার : আসলে নারীর অগ্রগতিটা আমার মতে সমাজের সঙ্গে নির্ভরশীল। সমাজ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, নারীরাও কিন্তু সেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বর্তমান যে প্রজন্ম সেই প্রজন্ম বড় হয়েছি মীনা-রাজুর কার্টুনে নারীদের বৈষম্য করণের যে বার্তা সেই বার্তা দেখে। বড় হয়ে তবু আমরা দেখছি নারী ধর্ষণ এবং বিভিন্ন অরাজকতা কাজ করছে। কিন্তু সব থেকে আশার কথা হচ্ছে এইগুলো যে আমরা যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম তখন কিন্তু আমরা দেখতাম যে পত্রিকার হেডলাইন হতো যৌতুকের জন্য গৃহবধূকে নির্যাতন, পত্রিকার হেডলাইন হতো অ্যাসিড নিক্ষেপের ফলে বোনটি কিন্তু কলেজে যেতে পারছে না। ইভটিজিংয়ের ভয়ে কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীকে ড্রপ দিতে দেখেছি। কিন্তু আমরা সেই সমাজ থেকে অনেকটা হলেও দূরে চলে এসেছি। আমরা এখন সেই সমাজ দেখতে পাচ্ছি না। আমরা দেখতে পাচ্ছি নারী কিন্তু আজ জেগে উঠেছে, কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে আজ বলতে শিখেছে।
এনটিভি অনলাইন : নারীবান্ধব সমাজ গঠনে কী কী প্রয়োজন আছে?
তিলোত্তমা সিকদার : আমি আসলে এ প্রশ্নটার সঙ্গে একমত না। আমি মনে করি না যে একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের কেন নারীবান্ধব সমাজ গঠন করতে হবে? নারীবান্ধব সমাজের পক্ষে আমি কখনোই না, আমি একটি সমতার সমাজ গঠনের পক্ষে।
এনটিভি অনলাইন : রাজনীতি করতে এসে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা?
তিলোত্তমা সিকদার : আমি মনে করি, রাজনীতিতেই মেয়েদের বাধা না, মেয়েদের সবক্ষেত্রেই কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু ফুলকে ফুলের কলিকে ঝরে পড়া যাবে না, তাকে ফুটতেই হবে। সবার জন্য আমার একটি কথা থাকবে, কখনো বাধার সম্মুখীন হয়ে মেয়েরা যেন ঝরে না যায়, বসন্তের নতুন পাতার মতো, নতুন ফুলের মতো প্রতিটি মেয়েই সুন্দর করে ফুটুক। বাধার সম্মুখীন বলতে প্রতিটি মেয়েকেই তার সফলতাকে বিভিন্নভাবে ক্লাসিফাই করা হয়। ক্লাসিফাই বলতে নারীর সাফল্যকে কিন্তু তার পোশাক, লাল লিপস্টিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। এই জিনিসগুলো কিন্তু আমার রাজনীতির ক্ষেত্রে না, প্রত্যেকটি পেশার সঙ্গেই যে ক্লাসে প্রথম হচ্ছে বা চাকরিতে ভালো করছে তাকে এসব ক্লাসিফাইয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তো এমন সমাজ থেকে আমরা যেন দূরে থাকতে পারি, প্রত্যেকটা মেয়েকে যেন তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করতে পারি সেই সমাজেরই স্বপ্ন দেখি।
এনটিভি অনলাইন : আমাদের দেশে কি নারীদের কাজ করার মতো পরিবেশ আছে?
তিলোত্তমা সিকদার : আমাদের দেশরত্ন শেখ হাসিনা যখন নারীদের নমিনেশন দিচ্ছিলেন, তখন গণভবনে উনি বলছিলেন যে, ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী, আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’। কারণ, আমরা দেখেছি যে নারীদের এতো অগ্রগতি, আগে নারীদের রাজনীতিতে যতটা আগ্রহ ছিল তার থেকে অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে অংশগ্রহণ এবং অনেক নমিনেশন ফরম বিক্রি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই কথাটি বলেছিলেন। নারীদের এতো অংশগ্রহণ আসলেই নারীদের স্বাধীনতার বার্তাকে বয়ে নিয়ে আসছে। নারীবান্ধব সমাজ কিন্তু এখন থেকে উঠে আসেনি এটা কিন্তু সেই বেগম রোকেয়ার সময় থেকে উঠে আসছে যখন সে আলোর মশাল জ্বালিয়ে প্রতিটি অলিতে-গলিতে কিন্তু নারী মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পর কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীদের সমাজ গঠনের জন্য ১০ শতাংশ কোটা তখনই চালু করেছিলেন। আবার সেই ১৯৯৬ সালের কথা যখন আমাদের নারীদেরকেই সরকারি সচিব পদে দেওয়ার মতো একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। আমরা দেখছি আজ শুধু নারী তার বাসায়ই গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে ইচ্ছুক না, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যেকটি কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে চলছে এমনকি আমরা দেখছি যে আমাদের আকাশযান থেকে শুরু করে রিকশাচালানো সব ক্ষেত্রেই কিন্তু নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলোই আসলেই নারীবান্ধব সমাজের প্রতীক। আমাদের সমাজ যে সমতার সমাজের দিকে যাচ্ছে এটি কিন্তু তারই একটি বার্তা৷
এনটিভি অনলাইন : আপনার রাজনীতিতে আসার শুরুর গল্প।
তিলোত্তমা সিকদার: রাজনীতি শুরু বলতে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে অনেকেরই ভাবনা থাকে কেমন হবে ছাত্ররাজনীতি। আমার রাজনীতির শুরুটা আমার পরিবার থেকে। আমার বাবা হচ্ছেন আমার অনুপ্রেরণা। যখন আমি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি তখন আমাদের মেয়েদের অনুপ্রেরণা অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
এনটিভি অনলাইন : একজন নারীর স্বাধীনতা কী? সেটা কি স্বাবলম্বী হওয়া নাকি ব্যক্তি মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা?
তিলোত্তমা সিকদার : ব্যক্তি মতামত প্রকাশ করা, স্বাবলম্বী হওয়া সবগুলোই কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের মধ্যে পরে। শুধু আমি আমার অধিকারের কথা বলতে পারব সেটাই কিন্তু স্বাধীনতা না, আমি পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবদান রাখতে পারব, আমি প্রতিটি সেক্টরে কাজ করতে পারব, আমি স্বাবলম্বী হতে পারব—এগুলো কিন্তু নারীর স্বাধীনতার মধ্যেই পড়ে। আমরা চাই নারী এমনই হবে সে রোদেলা দুপুরে গ্রাম্যপুকুরে মধ্যবয়সী মেয়ের অবাধ সাঁতারের মতোই সে নারীর স্বাধীনতা মেয়েদের জন্য আসবে।