নায়ক রিয়াজের শ্বশুরের আত্মহত্যা : সেদিন কী ঘটেছিল মহসিনের ফ্ল্যাটে?
ফেসবুক লাইভে এসে চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মহসিন খান বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মাথায় নিজের পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। এর আগে দীর্ঘ সময়ের বক্তব্যে তুলে ধরেন তাঁর জীবনের একাকীত্বের কথা। আত্মীয়-স্বজন অনেকে ফেসবুক লাইভে দূর থেকে তাঁর কথা শুনলেও পাশের ফ্ল্যাট থেকে কেউই শুনতে পাননি গুলির শব্দ।
আত্মহত্যার আগে তাঁর পূর্ব প্রস্তুতি এবং পরে কী ঘটেছিল রাজধানীর ধানমণ্ডির ৭ নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর বাড়ির ওই ফ্ল্যাটে, তা নিয়ে মহসিনের স্বজন, প্রতিবেশী ও ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে নানা তথ্য।
লাইভ দেখে পুলিশ সুপার ইমতিয়াজ খোঁজ নিতে বলেন ম্যানেজারকে
মহসিনের ফেসবুক লাইভ নজরে আসে ওই ভবনের বাসিন্দা পুলিশ সুপার ইমতিয়াজের। তিনি তখন বাইরে। বহুতল ভবনের ম্যানেজার আব্দুর রহিমকে মুঠোফোনে তখন খোঁজ নিতে বলেন।
আব্দুর রহিম পঞ্চমতলায় মহসিনের ফ্ল্যাটের সামনে যান। পাশের ফ্ল্যাটের মালিক মো. আসাদের স্ত্রী তানিয়া সুলতানাকে ডাকেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ঢোকেন মহসিনের ফ্ল্যাটে। তানিয়া ধাক্কা দিতেই খুলে যায় মূল দরজা।
রহিম জানান, দরজা খোলাই ছিল। প্রথম ওই ঘরে ঢোকেন তানিয়া। পেছন পেছন প্রবেশ করেন ম্যানেজার রহিম ও ভবনের এক নিরাপত্তাকর্মী।
তানিয়ার বর্ণনায় প্রথম অবস্থা
বাসায় ঢুকে তানিয়া দেখতে পান, বিছানায় রক্ত। আবু মহসিন খান পড়ে আছেন। পাশেই পড়ে আছে প্রাণনাশকারী অস্ত্রটি। টেবিলে রাখা আছে কাফনের কাপড়, সুইসাইড নোট ও একটি ডায়েরি। তখন তানিয়া বুঝতে বাকি থাকে না, মহসিন নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন।
তানিয়া জানান, ঘরে ঢুকে নিজ চোখে দেখার আগে ফেসবুক লাইভ দেখেননি তিনি, শোনেননি গুলির শব্দও। রক্ত ও লাশ দেখে খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর ম্যানেজার রহিম ধানমণ্ডি থানায় বিষয়টি জানান। পরে থানা থেকে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।
তানিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ঘরে ঢুকে প্রথম ভেবেছিলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। পরে রক্ত ও পিস্তল পড়ে থাকতে দেখে নিশ্চিত হই, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’
ঘটনাস্থলে সিআইডি
তখন প্রায় রাত সাড়ে ১০টা। ঘটনাস্থলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট আসে। সিআইডি আত্মহত্যার আলামত জব্দ করে। পরে পুলিশ মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়।
অর্ধদিন রক্তমাখা ছিল ঘর
আলামত জব্দের পরও গতকাল রাত থেকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত রক্তমাখা ছিল মহসিনের ঘর। পরিচ্ছন্ন করেননি কেউ। আজ দুপুরে মরদেহ ঢামেক হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার আগে মৃতের মেয়ের জামাই নায়ক রিয়াজের তত্ত্বাবধানে করানো হয় পরিষ্কার।
রক্তমাখা ঘর পরিষ্কার করেন আনজু আরা
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ঠিক ১টার সময় ওই পঞ্চমতলার শ্বশুরের ফ্ল্যাটে যান আবু মহসিন খানের বড় মেয়ে তিনার স্বামী চলচ্চিত্র অভিনেতা রিয়াজ। সঙ্গে যান আরও দুই স্বজন। ভবনের সিঁড়ি মোছার কাজ করা আনজু আরা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পানি দিয়ে সব রক্ত ধুয়েছি। রক্তের ওপর মাটি দেওয়া ছিল। মনে হয়, কাল রাতেই মাটি দিয়ে রাখছিল। সেগুলো ধুয়ে পুরো বাসা গুছিয়ে ঝাড়ু দিয়েছি।’
ভবনে মরদেহ আনার সময় সঙ্গে ছিল না স্বজন
ঠিক দুপুর ১টা ২০ মিনিট। রিয়াজকে নিচে নামতে দেখা যায়। সে সময় মহসিনের মরদেহ বহন করে আনে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি। তখন সেখানে মহসিনের কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না। লাশবাহী গাড়ির সঙ্গেও ছিল না কেউ।
লাশবাহী গাড়ির চালক মরদেহের পাশে আগরবাতি জ্বালিয়ে দেন। তার আগেই মহসিনের মেয়ের জামাই নায়ক রিয়াজ শ্বশুরের ফ্ল্যাটের দিকে উঠে যান।
মহসিনের শাশুড়ির বিলাপে ভারি ফ্ল্যাট
মহসিনের ফ্ল্যাটের ভবনে মরদেহ পৌঁছার ঘণ্টাখানেক পর কিছু আত্মীয়-স্বজন আসতে থাকেন। এ সময় দেখা যায় মহসিনের শাশুড়িকে। তিনি বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘কেন সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমি মানতে পারছি না। আমার বুকটা জ্বলে যাচ্ছে।’
ভাইয়ের বক্তব্যে একাকীত্বের ফ্ল্যাটজীবন
আবু মহসিন খানের ছোট ভাই আবু হাসান মো. ওয়াহিদুজ্জামান লিপু বলেন, ‘একাকীত্ব তাঁকে খেয়ে ফেলেছে। মানুষ একা বাঁচতে পারে না। একটা মানুষ ৩ থেকে ৪ বছর একটা ফ্ল্যাটে একা থাকেন। তার ওয়াইফ ও ছেলে দেশের বাইরে থাকেন। একাকীত্বের এই লম্বা সময়ে লকডাউন ছিল, করোনা ছিল।’
লিপু বলেন, ‘তিনি (মহসিন) ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। ওনার অপারেশনও হয়েছে। যদিও এ সময়ে তিনি সুস্থ ছিলেন বলে জানি। ঘুরে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে। আবার যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। এটাও তাঁর জন্য একটি হতাশার কারণ হতে পারে।’
নায়ক রিয়াজের বক্তব্য
চিত্রনায়ক রিয়াজের কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার শ্বশুর মারা গেছেন। আপনারা সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন কিছুই ভাবতে পারছি না।’
নায়ক রিয়াজ জানান, তাঁর শ্বশুড়ের ইচ্ছে অনুযায়ী মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কবরস্থানে দাফন করা হবে।
যে সব আলামত জব্দ করেছে পুলিশ
ধানমণ্ডি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেবলাল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে কিছু আলামত সংগ্রহ করি। সেখানে একটি ডায়েরি পাই। ওই ডায়েরিতে তাঁর ব্যক্তিজীবনের চাওয়া-পাওয়া, হতাশাসহ নানাকিছু লেখা আছে। আমরা সেটি জব্দ করেছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন স্যারেরা সেটি যাচাই-বাছাই করছেন। ঘটনা জানার চেষ্টা করছেন। তাঁর (আবু মহসিন খান) মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় লেখা থাকলেও তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর আত্মহত্যার ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।’