নেত্রকোনায় অনাবৃষ্টি ও দাবদাহে আমনের আবাদ হুমকির মুখে
খরা ও অনাবৃষ্টিতে পানি শূন্য ফসলের মাঠ। প্রচণ্ড দাবদাহ ও অনাবৃষ্টি থাকায় জমিন ফেটে চৌচির হয়ে অনেক ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। এতে চলতি মৌসুমে রোপা আমন আবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। সার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা নেত্রকোনার কৃষকেরা। তীব্র খরায় আমন ক্ষেত ফেটে চৌচির এবং রোদে পুড়ে ধানের চারা বিবর্ণ হয়ে পড়ায় জেলায় রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি রোপা আমন মওসুমে নেত্রকোনা জেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৫৮০ হেক্টর। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৬২ হাজার ৫৯৬ টন। সরকার ১ আগস্ট থেকে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়িয়েছে। ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ খুচরা দাম প্রতি কেজি ১৪ থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২২ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। হঠাৎ করে ইউরিয়া সার ও তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে চলতি আমন মৌসুমে চাষাবাদ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা।
কৃষিনির্ভর জেলায় বিগত দিনে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলেও বর্তমান চলছে খরা ও অনাবৃষ্টি। পানির অভাবে আমন মৌসুমে ধানের আবাদ বিলম্ব হওয়ায় অনেকেরই সেচ পাম্প ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়া ধানের চারা সেচ দিয়ে টিকিয়ে রাখছেন কৃষকেরা। বৃষ্টির পানির বিকল্প হিসেবে শ্যালো মেশিন কিংবা গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানির সংকট মেটানোর চেষ্টা করলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কোনো কোনো স্থানে বৃষ্টির বিকল্প পদ্ধতিতে সংকট মেটানো প্রায় অসম্ভব।
এক দিকে পানির অভাব অন্যদিকে তেল সারের মুল্য বৃদ্ধি তার মধ্যে ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং সব মিলে শক্ষায় কৃষক। এ বছর শ্রাবণ মাস জুড়েই চলছে স্মরণকালের ভয়াবহ খরা। ১৫ আষাঢ় থেকে আমন ধান রোপনের মৌসুম শুরু হলেও বৃষ্টির অভাবে জমিতে ধান রোপন করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু এলাকায় রোপণ কাজ সম্পন্ন হলেও ফেটে যাচ্ছে ফসলের মাঠ। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে কৃষকের গোলায় ধান উঠবে কি না এ নিয়ে শংকিত প্রান্তিক চাষীরা।
আমন ধান রোপণ কার্যক্রম সাধারণত বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নেত্রকোনায় বৃষ্টির দেখা নেই। অন্যদিকে দাবদাহে আমন রোপণের জন্য প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও চারা রোপণ করা গেলেও ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা সদরসহ কেন্দুয়া, পূর্বধলা, আটপাড়া, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও বারহাট্রা উপজেলার মাঠের পর মাঠ শুকিয়ে ফসলের জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাষাবাদ এখন অনেকটাই যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছে। ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষাবাদের পাশাপাশি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা এবং হ্যান্ডট্রলি দিয়ে তা বাড়িতে আনা হচ্ছে। সার, ডিজেল ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানে জমি চাষাবাদ, ধানের চারা রোপন, ধান কাটা এবং তা ঘরে তোলা এবং বাজারজাত করা পর্যন্ত সর্বত্র বাড়তি দামের প্রভাব পড়বে।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার সিংহের বাংলা গ্রামের কৃষক দীপক চক্রবর্তী বলেন, ‘বর্ষাকাল তথা আষাড়ের শেষ ও শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা হালচাষ দিয়ে জমি তৈরি করে ধান লাগাতাম। কিন্তু আষাড় শ্রাবণ মাসে সময় মতো প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং প্রচণ্ড খরার কারণে এখনও অনেক জমি পতিত পড়ে আছে।’
কেন্দুয়া উপজেলার রোয়ালবাড়ী গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর বৃষ্টিপাতের দেখা নেই। তাই আমন ধান আবাদ হয়ে গেছে অনেকটা সেচনির্ভর। শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ এবং ট্রাক্টর দিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে কৃষকের খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।’
পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া গ্রামের কৃষক দুলাল মন্ডল বলেন, ‘প্রচন্ড খরায় জমি ফেটে চৌচির হয়ে ধানের চারা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। একটু বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন কৃষকেরা। লাগানো জমিতে ধান বাঁচাতে মহা দুশ্চিন্তায় পড়েছে কৃষকেরা। একটু বৃষ্টি হলেই আমন চাষে এবং রোপন ধানের পরিচর্যা কাজে ফিরতে পারলেই কৃষকের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসবে। বৃষ্টির দিকে চেয়ে আছে মানুষ।’
আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া গ্রামের মনি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগে এক কাঠা জমি ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদ করতে যেখানে লাগতো ২০০ টাকা। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সেই জমি চাষ করতে লাগছে সাড়ে ৩০০ টাকা।’
বারহাট্রা উপজেলার বাউশী বড়ইতলা গ্রামের কৃষক জিয়াউর রহমান খোকন বলেন, ‘হঠাৎ করে সার ও ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি খরচের ধকল সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শ্রমিক সংকট ও শ্রমিকের দিন মজুরি বৃদ্ধিও আমাদেরকে ভোগাচ্ছে। এখন দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে এবং খরার কারণে কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।’
নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী উদ্যোগের কারণে একদিকে কৃষি খাতে যান্ত্রিকীকরণ হওয়ায় কৃষকরা এর নানা সুফল ভোগ করছে। বুধবার পর্যন্ত নেত্রকোনা জেলায় এক লাখ ৩২ হাজার ৫৮০ হেক্টর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মধ্যে প্রায় ৯৪ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার ভোর রাতে বেশ কিছু এলাকায় ভালই বৃষ্টি হয়েছে। আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।’