পণ্য বা টাকা চাইলে টর্চার সেলে যেতে হতো ক্রেতাকে
প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ফাল্গুনী শপ ডট কমের সিইও পাভেল হোসেনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল বুধবার থেকে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাজধানীর বনশ্রী এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পণ্য বা টাকা ফেরত চাইলে তাদের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৪-এর অধিনায়ক মোজ্জাম্মেল হক।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন পাভেল হোসেন (৩০), সাইদুল ইসলাম (৪০), আব্দুল্লাহ আল হাসান (২৫) ও ফারজানা আক্তার মিম (২১)।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অভিযানে ফাল্গুনী শপ ডট কমের অফিস থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, দুই রাউন্ড গুলি, ২৪টি ক্যান বিয়ার, চার বোতল দেশি মদ, একটি প্রাইভেটকার, কম্পিউটার, প্রিন্টার, বিপুল পরিমাণএন-৯৫ মাস্ক, ১০০টি ইনভয়েস, ৩০ চেকবই, ৮০টি সিল ও বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপনের স্ক্রিনশট উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া অভিযানে ওয়্যার হাউজ থেকে ৪২৩ কেজি চা পাতা, ৭১৫ কেজি চাল, ৪১২ কেজি মসুর ডাল, ২৬০ কেজি ফুলক্রিম মিল্ক, আটটি বাইসাইকেল, ৪৫০ লিটার সয়াবিন তেল, ২১৪ লিটার সরিষার তেল, ৫০ কেজি লবণ, ১১০ কেজি হুইল পাউডার, গ্লাস ক্লিনার, হারপিকসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয় বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
ক্রেতার অভিযোগের বরাত দিয়ে মোজাম্মেলক হক বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত পাভেলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও প্রতারণার মামলা রয়েছে। তার কাছে কোনো ভুক্তভোগী পণ্য অথবা তাদের পরিশোধকৃত টাকা চাইতে অফিসে গেলে তিনি তাদের পণ্য ও টাকা ফেরত দিতেন না। বরং ভুক্তভোগীদের অস্ত্র দেখিয়ে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতিসহ তার নিজস্ব টর্চার সেলে লাঠিপেটা, বৈদ্যুতিক শকসহ অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অফিস থেকে তাড়িয়ে দিতেন।’
প্রতারক পাভেলের উত্থানের গল্প বর্ণনা করতে গিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ফাল্গুনী শপ ডট কম কারসাজির মূলহোতা পাভেল হোসেন। যিনি প্রতিষ্ঠানটির সিইও এবং গ্রেপ্তারকৃত মো. সাইদুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল হাসান ও ফারজানা আক্তার মিম তার অন্যতম সহযোগী। পাভেল ১৯৯১ সালে গোপালগঞ্জের সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ।
পাভেলের বাবা গোপালগঞ্জের একটি সরকারি অফিসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ২০০৭ সালে গোপালগঞ্জের একটি স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ২০১৪ সালে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। ২০০৯ সালে এইচএসসি অধ্যয়নরত অবস্থায় পাভেল একটি অস্ত্রসহ র্যাবের কাছে আটক হয় এবং তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
র্যাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পাভেল হোসেন ২০১৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রজেক্টে রাজবাড়ীতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। পরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঠিকাদার হিসেবে কাজ করার সময় তার পরিচিত একজন তাকে অনলাইন ব্যবসা করার পরিকল্পনা দেন। ২০১৯ সালের শুরুতে পাভেল, জনৈক দিদারুল আলম, কানিজ ফাতেমা ও রহমতুল্লাহ শওকত মিলে ফাল্গুনী শপ ডট কম নামের একটি অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন।
‘ব্যবসার শুরুতে তারা উত্তরা এলাকায় একটি ভাড়াকৃত স্পেসে আউটলেট খুলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেন। তবে, শুরুতেই পাভেলের অন্য অংশীদাররা তার এই গ্রাহক ঠকানোর বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং তারা তার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেন এবং অ্যাফিডেভিট করে উকিল নোটিশ পাঠিয়ে যৌথ ব্যবসা থেকে সড়ে পড়েন। তারা এ বিষয়টি জয়েন্ট স্টক অথরিটিকেও অবহিত করে। এরপরও পাভেল তাদের নামে জাল সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে গ্রাহকদের প্রতারিত করত এমনকি তাদের নাম ব্যবহার করে যৌথনামে চেক পর্যন্ত ইস্যু করত।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২১ সালের মে মাসে প্রতারণার অভিযোগে কয়েকজন গ্রাহক পাভেলের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় প্রতারণার মামলা করেন। পাভেল সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ২১ দিন জেলে থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন এবং আগের চেয়েও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কিছু সংখ্যক গ্রাহক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করলে অধিদপ্তর কর্তৃক একাধিকবার ফাল্গুনী শপ ডট কমের আউটলেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের জুলাই মাসে পাভেল খিলগাঁও থানাধীন বনশ্রী এলাকায় ‘অরিমপো ডট কম’ ও ‘টেক ফ্যামিলি ডট কম’ নামে নতুন অফিস স্থাপন করে এর আড়ালেই ফাল্গুনী শপ ডট কমের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অরিমপো ডট কম ও টেক ফ্যামিলি ডট কমে পাভেল নিজে এমডি ও তার স্ত্রী রিতা আক্তার চেয়ারম্যান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।