পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মুজিবনগর দিবসের শুভ সূচনা
আজ ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। মহামারি নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সব আয়োজন বন্ধ রেখে স্বল্প পরিসরে দিবসটি উদ্যাপন করছে জেলা আওয়ামী লীগ। আজ শনিবার সকাল ৬টার দিকে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মুজিবনগর দিবসের শুভ সূচনা করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. মুনসুর আলম খান।
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিরুল ইসলাম, জেলা আনসার কমান্ডার রাকিবুল ইসলামসহ আনসার ভিডিপি ও পুলিশ সদস্যেরা। পতাকা উত্তোলন শেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন ও বীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। এ ছাড়া সকাল ৯ টার দিকে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন জাতীয় সংসদের হুইপ জয়পুরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।
এরপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ ছাড়া শ্রদ্ধা জানাবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন প্রমুখ।
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য একটি দিন আজ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই দিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। পরে এই বৈদ্যনাথতলাকেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়।
এর আগে একই বছরের ১০ এপ্রিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। পরের দিন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। এ ভাষণে তিনি দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।
তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এরই পথপরিক্রমায় ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে প্রবাসী সরকারের এক অধ্যাদেশে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।
সদ্যপ্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের নির্বাচিত জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি গোপন স্থানে মিলিত হয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করেন। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম পরে তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন।
মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা হলেন—এম মনসুর আলী (অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প) এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি)। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি খন্দকার মোশতাক আহমদও (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ) প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন।
মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি বিভাগ মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে থাকে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০ নম্বর বা নৌসেক্টরে কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিল না। কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করতেন সেই সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকতেন। এ ছাড়া জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়।
মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এখানে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। আর সেই অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেছিলেন ১৭ বছরের এক কিশোর মো. বাকের আলী, যিনি কয়েক বছর আগে কলেজ শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। সেদিন কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে তিনি এই দায়িত্বটি পালন করেছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন।
বাকের আলী তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্তটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি দর্শনা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিহারি-অধ্যুষিত দর্শনায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুযোগ বুঝে দীর্ঘ পথ হেঁটে ১৬ এপ্রিল বিকেলে বর্তমান মুজিবনগর উপজেলার গৌরীনগর গ্রামের নিজ বাড়িতে চলে আসি।’
বাকের আলী আরও বলেন, “ওই দিন রাতে শুনলাম ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। কীসের সভা, কী উদ্দেশে হবে সবকিছুই রয়ে গেল অজানা। সকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার স্কুলশিক্ষক দোয়াজ উদ্দিন স্যার সেখানে ছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে বলেন, ‘তোকে এ অনুষ্ঠানে কোরআন পাঠ করতে হবে’।”
এ প্রসঙ্গে বাকের আলীর শিক্ষক দোয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘বাকের স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করত। এ ছাড়া সে ছিল ধর্মভীরু। তাই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাকেই টেনে নিয়েছিলাম।’
এদিকে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীরা শপথ নিলেও ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করা হয়। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। শুধু তাই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এই প্রথম সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর আগে ভারত এবং ভুটান এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।