পরিবেশ রক্ষায় সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই : মির্জা ফখরুল
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির শাসনমালে পথিলিত ব্যাগ নিষিদ্ধ, খাল খনন কর্মসূচি চালু, থ্রি-স্ট্রোক বেবি ট্যাক্সি চলাচল নিষিদ্ধসহ পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে আজ শুক্রবার (৫ মে) জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক সেমিনারে বিএনপির মহাসচিব এই অভিযোগ করেন।
রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে বিএনপির উদ্যোগে ‘জলবায়ু পরিবর্তন : বাংলাদেশ ও নদী’ শীর্ষক এই সেমিনার হয়। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন হাসনা জসীম উদ্দিন মওদুদ। চার পৃষ্ঠার প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি প্রবাহ, ভারতের উজানে বাঁধ নির্মাণে এর ক্ষতিকারক দিক, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্রের প্রতি হুমকির বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
সেমিনারে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখন এগুলোর (পরিবেশ দূষণ রোধ) ওপরে কোনো গুরুত্ব না দেয়ার ফলে ঢাকা দেশের অন্যতম না, বোধহয় সবচেয়ে দুষিত নগরীতে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের কোনো লক্ষ্য নেই। এই বিষয়গুলোকে এড্রেস করার জন্য, জনগণের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, জনগণের অন্তত বেঁচে থাকার জন্য, জীবন-জীবিকার পথকে সুগম করার জন্য তাদের খুব বেশি আগ্রহ নেই।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘কারণ তাদেরকে তো জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না, তারা নির্বাচিত নয়, জোর করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। লক্ষ্য একটাই যে, আমাকে যে করেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। এই কারণে পরিবেশ রক্ষায় তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।’
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এখন আমি বাংলাদেশের যেসব জায়গায় যাই নদী আর বেশি দেখতে পাই না। দূরে যাওয়ার দরকার নেই... ঢাকার পাশেই বুড়িগঙ্গা… আগে কেমন ছিল, আর আজকে সেই বুড়িগঙ্গায় কি দেখছি, শীতালক্ষ্যায় কি দেখছি। আজকে আমাদের মানুষের অবহেলায়, সরকারের অব্যবস্থাপনায়, তাদের পরিকল্পনার অভাবে সেগুলোকে নিয়ে আমরা বেঁচে আছি, আমাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে যার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য সেগুলোকে আমরা নিজেরাই হত্যা করছি, ধ্বংস করে দিচ্ছি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকার উন্নয়নের ঢাক-ঢোল বাজায় সর্বক্ষণ। কিন্তু নদীকে রক্ষায়, নদীকে সঠিকভাবে পরিশুদ্ধ রাখতে তাদের কোনো পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত চোখে পড়ে না।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সাভার-ধামরাইতে ছোট ছোট যে নদীগুলো ছিল সেগুলো প্রায় মরে গেছে। আপনারা দেখেছেন যে, তুরাগ নদীর পাশে সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সযোগিতায় ও তাদের সমর্থনের ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ক্লাব গড়ে উঠেছে। সেই ক্লাবগুলো একেবারেই নদীর ওপরে নদী ভরাট করে গড়ে উঠেছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘পানি কমে যাচ্ছে, নদী দখল করা হচ্ছে-এটার বিষয়ে যা কিছু খবর নেবেন-এই সরকারের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই এই কাজগুলো করছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, এই গ্রহ বড় রকমের হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা তো আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর দরকার নাই। আমরা বাংলাদেশের মানুষ আমরা বেঁচে থাকবো কি থাকব না, সুস্থ-সুন্দরভাবে আমরা এখানে বাঁচতে পারব কিনা সেটা আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজকে বাংলাদেশের মানুষকে যদি টিকে থাকতে হয়, ভবিষ্যতকে যদি সুন্দর করতে হয়, ভবিষ্যতকে যদি সত্যিকার অর্থেই জনগণমুখী করতে হয় তাহলে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আজকে গণতন্ত্র নেই বলেই কোনো জবাবদিহিতা নেই।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মেজর হাফিজ সাহেব (সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ) যেটা বলেছেন যে, তিনি দিল্লিতে গিয়ে যখন নদী কমিশনে নেগোসিয়েশন করছিলেন-এই শক্তি তার ছিলো। একটা নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন বলে, জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন বলেই বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র…. ওই সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের ফারাক্কা বাঁধে কত বড় ক্ষতি হয়েছে সেটা আমরা জানি, তিস্তার পানি দিচ্ছে না যার ফলে ওই অঞ্চল (উত্তরাঞ্চল) পুরোপুরি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। অথচ এখনও এই সরকার সেভাবে কথা বলেই না।’ টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিএনপির ভুমিকা তুলে করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘টিপাইমুখ বাঁধ যখন নির্মাণ করতে যায় তখনই আপত্তি করেছিল বিএনপি সরকার, বিএনপি আন্দোলন গড়ে তু্লেছিলো। যার জন্যে আমাদের ইলিয়াস আলীকে সম্ভবত অনেক মনে করেন সেই কারণে তাকে গুম হতে হয়েছে। এটা বড় লড়াই, বড় সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদেরকে জিততে হবে, আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতেই হবে। সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে পারলেই আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারব, উদ্যোগ নিতে পারব। আমরা আমাদের যে সমস্যাগুলো আছে সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে বুক ফুলিয়ে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। জাতিসংঘে তুলে ধরতে পারব, বিশ্ব পরিমণ্ডলে এটার একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
সেমিনারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন যে, মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে আমাদের বাংলাদেশের নদীগুলো কি পরিমাণ গতি হারিয়েছে এবং কি পরিমাণ চরিত্রগতভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। একটা উদাহরণ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সেটা ফারাক্কা চুক্তি। আওয়ামী লীগ সরকার যখন দ্বিতীয় চুক্তিটি করেছিল সেটাতে গ্যারান্টি ক্লজ নাই। ফারাক্কা পয়েন্টে একটা গ্যারেন্টি ক্লজ থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন চুক্তি করেছিলেন সেখানে ফারাক্কার পয়েন্টে গ্যারেন্টি ক্লজ ছিলো। আওয়ামী লীগ আমলের চুক্তিতে আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে গ্যারেন্টি ক্লজ রাখেনি।’
খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘তিস্তাসহ ৫৪ নদীর উপরিভাগে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। ফলে আমাদের নদীতে পানি কম আসছে, আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীর পানির মাধ্যমে যে পলি আমাদের দেশে আসতো সেই পলি কমে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে কৃষি ও কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ, কৃষি নির্ভর দেশ। এখানে আমরা অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা, ব্রিজ ইত্যাদি নির্মাণ করছি শুধু লোক দেখানোর জন্য অথবা কোনো দেশের ইঙ্গিতে ভয়ে তাদেরকে খুশি করার জন্য করছি। এতে আমরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি এটা কিন্তু আমাদের সকলকে আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।’ নদী দখল রোধ করতে দীর্ঘ-মধ্যম এবং বর্তমান অবস্থায় করণীয় পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে বলে মন্তব্য করেন খন্দকার মোশাররফ।
সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা আমাদের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এটা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। সরকারকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে, সরকারের মেরুদণ্ড সোজা থাকতে হবে। বলতে হবে আমার দেশের নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা চাই।’
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যৌথ নদী কমিশনের মিটিং বছরে চার বার হতে হবে, সেখানে আমাদের ন্যায্য হিস্যার গ্যারান্টি দিতে হবে… প্রত্যেকটা চুক্তির গ্যারান্টি ক্লজ থাকতে হবে, আরবিটেশন ক্লজ থাকতে হবে।’ নদ-নদীর পানির ন্যায্য বন্টনে ভারত সরকারের একতরফা ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী।
বিএনপির মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও দলের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সহসম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল ও কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপুর যৌথ সঞ্চালনায় সেমিনারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন এবং সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বক্তব্য দেন।