পরী মণির বাসায় মিনিবার, মাদক দিতেন প্রযোজক রাজ
চিত্রনায়িকা পরী মণির বাসায় মিলেছে মিনিবার। সেখানে ডিজে পার্টি হতো। অনেকে সেখানে যাতায়াত করতেন। পরী মণিকে মাদক সরবরাহ করতেন প্রযোজক ও অভিনেতা মো. নজরুল ইসলাম রাজসহ বেশ কয়েকজন।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর র্যাব সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নজরুল রাজের সিন্ডিকেট রাজধানীর গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় ডিজে পার্টির আয়োজন করত। এসব পার্টিতে অনেক অবৈধ কর্মকাণ্ড তৈরি হতো। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করত। নজরুল রাজের ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’র কার্যালয়ে বিভিন্ন অপকর্ম হতো। তিনি কয়েকজন অবৈধ অর্থের যোগানদাতার নাম জানিয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন নাম উঠে এসেছে। সেগুলো আমরা যাচাই করছি। তদন্তের স্বার্থে এসব এখনই বলছি না। কারা আসতো-যেতো সেগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না যাচাই-বাছাই করছি। তদন্তের স্বার্থে এখন বলছি না। ১৯টি বিদেশি মদের বোতল পাওয়া গেছে পরী মণির বাসা থেকে। সামগ্রিকভাবে আমরা তদন্ত করছি। পরী মণির বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এবং রাজের বিরুদ্ধে মাদক ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, পরী মণির মদ খাওয়ার লাইসেন্স থাকলেও তা ছিল মেয়াদ উত্তীর্ণ।
এর আগে র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৩ আগস্ট রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং তার সহযোগী মো. মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকার গুলশান, বারিধারা ও বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টি আয়োজনের বেশ কয়েকটি স্থানের তথ্য প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১-এ অভিযান গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর বনানী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে শামসুর নাহার স্মৃতি ওরফে স্মৃতিমণি ওরফে পরী মণি (২৬) ও মো. নজরুল ইসলাম ওরফে রাজসহ (৩৯) চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত অপর সদস্যরা হলেন পরী মণির ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম দীপু (২৯) ও রাজের ম্যানেজার মো. সবুজ আলী (৩৫)। উদ্ধার করা হয় একটি মিনি বার পরিচালনার বিভিন্ন সরঞ্জামাদিসহ ১৯ বোতল বিভিন্ন প্রকার বিদেশি মদসহ দেড় শতাধিক ব্যবহৃত বিদেশি মদের বোতল, ইয়াবা ও সিসা সামগ্রী, এলএসডি; আইস ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
২০১৬ সাল থেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন পরী মণি
র্যাবের কমান্ডার খন্দকাল আল মঈন জানান, গ্রেপ্তারকৃত শামসুর নাহার স্মৃতি এই স্মৃতি মণি ওরফে পরী মণিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পিরোজপুরের কলেজে (এইচএসসি) জীবনে অধ্যায়নরত অবস্থায় চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। তিনি ২০১৪ সালে চিত্র জগতে অন্তর্ভুক্ত হন। এ পর্যন্ত তিনি ৩০টি সিনেমা এবং পাঁচ-সাতটি টিভিসিতে অভিনয় করেছেন। পিরোজপুর থেকে ঢাকায় এসে চিত্র জগতে একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরিতে গ্রেপ্তারকৃত মো. নজরুল ইসলাম রাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে তিনি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শামসুর নাহার স্মৃতি ওরফে পরী মণি ২০১৬ সাল থেকে অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর ফ্ল্যাট থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি নিয়মিত অ্যালকোহল সেবন করে থাকেন। মাত্রাতিরিক্ত সেবনের চাহিদা মেটানোর লক্ষে বাসায় একটি মিনিবার স্থাপন করেছেন। মিনিবার থাকায় তাঁর ফ্ল্যাটে ঘরোয়া পার্টির অয়োজন পরিপূর্ণতা পেত বলে তিনি জানান। গ্রেপ্তারকৃত মো. নজরুল ইসলাম রাজসহ আরও অনেকে তাঁর বাসায় অ্যালকোহলসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকের সরবরাহ করত এবং পার্টিতে অংশগ্রহণ করত বলে গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
মাদ্রাসায় পড়েছিলেন নজরুল রাজ
র্যাব জানায়, নজরুল রাজকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি ১৯৮৯ সালে খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। পরে ঢাকায় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন বলে দাবি করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারী কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি শোবিজ জগতেও তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটে। বিভিন্ন সিনেমা/নাটকে তিনি নানান চরিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নামে বেনামে প্রযোজনায় যুক্ত হন। রাজ মাল্টিমিডিয়া নামেও তাঁর একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসায়িক জগত ও চিত্র জগতের দুই ক্ষেত্রে তাঁর সংযোগ থাকায় তিনি অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিজ অবস্থানের অপব্যবহার করেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, নজরুল রাজ ইতোপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং মো. মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানের সহযোগিতায় ১০ থেকে ১২ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। উক্ত সিন্ডিকেটটি রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করে থাকে। উক্ত পার্টিতে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে সিন্ডিকেট সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত উচ্চবিত্ত অভিজাত পরিবারের সদস্য। প্রতিটি পার্টিতে ১৫ থেকে ২০ জন অংশগ্রহণ করত। এ ছাড়া সিন্ডিকেটটি বিদেশেও প্লেজার ট্রিপের আয়োজন করত। একইভাবে উচ্চবিত্ত প্রবাসীদের জন্যেও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টির আয়োজন করা হতো। পার্টি আয়োজনের ক্ষেত্রে আগত ব্যক্তিদের চাহিদা/পছন্দের গুরুত্ব দিয়ে পার্টিগুলো আয়োজন করত। গ্রেপ্তারকৃত নজরুল রাজের সিন্ডিকেট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করতেন। সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় তারা অগ্রসর হতেন ও স্বার্থ চরিতার্থ করতেন। রাজের ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’র কার্যালয়টি অনৈতিক কাজে ব্যবহৃত হতো।
নজরুল রাজ র্যাবকে জানিয়েছেন, এ জাতীয় অবৈধ আয় থেকে অর্থ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় আমদানি, ড্রেজার বালু ভরাট ও ঠিকাদারী এবং শোবিজ জগতে বিনিয়োগ করতেন। বর্ণিত ব্যবসায় বেশ কয়েকজন অবৈধ অর্থের যোগানদাতাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যবসায়িক কাঠামোতে অস্বচ্ছতা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।