পাঁচ শতাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছে ‘বস রাফি’
ভারতের বেঙ্গালুরের যে সেইফ হাউজে বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে এবং ভিডিওটি ধারণ করা হয়, সেটা ছিল সবুজের তত্ত্বাবধায়নে থাকা একটি সেইফ হাউজ। সে সেইফ হাউজের মালিক আশরাফুল মণ্ডল ওরফে বস রাফি। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল সোমবার থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত যশোর ও ঝিনাইদহ থেকে আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘দেশ থেকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচার করে তাদের সেইফ হাউজে রাখা হত। সেইফ হাউজে রাখার সময় তাদের বিভিন্ন এজেন্টদের মাধ্যমে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে ব্যবহার করা হতো। ওই পতিতাবৃত্তি থেকে যে টাকা আয় হতো, তার একটি বড় অংশ বস রাফির কাছে আসত।’
র্যাবের পরিচালক বলেন, ‘ওই কাজে যারা সাব-এজেন্ট হিসেবে যুক্ত থাকত, তাদের কাজ ছিল পাচারকৃত মেয়েগুলো যেন মুখ খুলতে না পারে এবং পালিয়ে যেতে না পারে। রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস। গত আট বছর ধরে তিনি ভারতে যাতায়াত করতেন। পাঁচ বছর ধরে তিনি নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত। দুই বছর আগে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। রাফি টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে পাওয়া অর্ধ শতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করেছে। তবে টিকটক হৃদয় ছাড়াও রাফির অন্যান্য এজেন্ট রয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বস রাফি আমাদের এ তথ্য জানিয়েছেন।’
রাফির বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনেকগুলো সেইফ হাউজ রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশের তত্ত্বাবধায়ক বা স্বত্বাধিকারী আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের মূল অন্যতম হোতা আশরাফুল মণ্ডল ওরফে বস রাফি। তার তত্ত্বাবধায়নে সবুজ ও ডালিমসহ বিভিন্ন ব্যক্তি সেইফ হাউজগুলো দেখাশোনা করত।’
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন আরও বলেছেন, ‘এ পর্যন্ত বস রাফি পাঁচ শতাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছেন। ভারতে পাচার করার জন্য রাফির প্রচুর নারী দরকার হয়, তাই তিনি হৃদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কারণ, রাফি বুঝতে পারেন যে, নারী সংগ্রহের জন্য টিকটক একটি ভালো মাধ্যম। সেজন্য রাফি টিকটক হৃদয়কে প্রলোভন দেখান যে, প্রতিটি নারী পাচারের জন্য তাকে একটি নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট দেওয়া হবে।’
র্যাবের পরিচালক বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও তরুণীদের পাশের দেশে পাচার করা হতো। এ চক্রের দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০ জন জড়িত। এ চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত রাফি এবং অন্যরা সবাই তার সহযোগী। ভুক্তভোগী তরুণী বা নারীদের বৈধ বা অবৈধপথে সীমানা অতিক্রম করানো হতো। সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা, যশোর ও ঝিনাইদহ দিয়ে তাদের ভারতে পাঠানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে এ পাচারের কাজটি সম্পন্ন করতেন। মূলত পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করতেই তাদের ভারতে পাচার করা হতো। পাচারের ফাঁকে ফাঁকে তাদের বিভিন্ন সেইফ হাউজে রাখা হতো। তারপর কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরুতে পাঠানোর পর বস রাফি তাদের বিভিন্ন সেইফ হাউজে রাখতেন। সেখানে তাদের মাদক সেবন করিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত করত। এ ছাড়া সেইফ হাউজগুলো থেকে বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য সরবরাহ করা হতো। এসব কাজে এজেন্টরা বস রাফিকে ১০ থেকে ১৫ হাজার কমিশন দিতেন।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত ম্যাডাম সাহিদা বস রাফির অন্যতম সহযোগী। সাহিদার একাধিক বিয়ে হয়েছে। তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া ওই পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে অবস্থান করছেন বলে সাহিদা জানান। ভারতে যৌন নির্যাতনের ওই ভিডিওতে তানিয়াকে সহযোগী হিসেবে দেখা গেছে। সাহিদা বাংলাদেশে একটি সেইফ হাউজ পরিচালনা করছে। ওই সেইফ হাউজে বিভিন্ন নারী সংক্রান্ত অবৈধ কাজ করা হয়। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল ও আরমান শেখ মূল হোতা বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করে থাকেন।’