পুলিশ হেফাজতে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ, ফাঁড়িপ্রধানসহ ৪ পুলিশ বরখাস্ত
টাকা না দেওয়ায় সিলেট নগরীতে রায়হান উদ্দিন আহমদ (৩০) নামের এক যুবক পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার পর আজ সোমবার সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানার অধীন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শকসহ (এসআই) চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে ওই ফাঁড়ির আরো তিন পুলিশ সদস্যকে।
বিকেলে সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপকমিশনার জ্যোতির্ময় সরকার বিষয়টি এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরো বলেন, ‘এরই মধ্যে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর আলী ভুঁইয়াসহ চারজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনজন প্রত্যাহার হয়েছে। ঘটনা তদন্তে এসএমপির উপকমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) আজবাহার আলী শেখকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত পরে জানানো হবে।’
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অন্য তিনজন হলেন ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।
গতকাল রোববার ভোরে রায়হান উদ্দিন আহমদ মারা যান। তিনি নগরের আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। রায়হানের বাবা একসময় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে এবং তাঁর দাদা পুলিশে চাকরি করতেন। রায়হান নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে দুজন চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। রাহনুমা আক্তার নামে দুই মাস বয়সী একটি কন্যাসন্তান রেখে গেছেন তিনি।
এর আগে গত শনিবার রাতে নিখোঁজ হন রায়হান। পরের দিন রোববার সকালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মরদেহের সন্ধান পায় পরিবার। স্বজনদের অভিযোগ, টাকা না পেয়ে রায়হানকে পুলিশি হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর পুলিশ দাবি করেছে, নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন রায়হান। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর বলছেন, যে এলাকায় গণপিটুনির কথা বলা হচ্ছে সেখানকার সিসিক্যামেরা ফুটেজে এ ধরনের কোনোকিছু দেখা যায়নি।
এ ঘটনায় গতকাল রাত আড়াইটার দিকে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত রাখা হয়েছে।
রায়হানের মা আজ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে তো ফাঁসির আসামি না। আমার ছেলে তো ছিনতাইয়ের আসামি না। তাহলে কেন মারা হইছে। আমার ছেলেকে হত্যা করা হইছে।‘
সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনীম বলেন, ‘যে এলাকায় গণপিটুনির কথা বলা হচ্ছে, সেই এলাকার ফুটেজটা আমরা দেখেছি। শনিবার রাত ২টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত দেখছি। কিন্তু গণপিটুনির কোনোকিছু এখানের ফুটেজে নাই। এটা শোনার পর কমবেশি অনেকের সঙ্গে এটা নিয়ে আমার আলাপ হয়েছে। কিন্তু কেই জানেন না ব্যাপারটা নিয়ে।‘
সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, ‘তদন্ত শুরু হয়েছে। যে ধরনের তথ্য ও প্রমাণাদি সংগ্রহ করা দরকার, তা করা হবে। কে বা কারা জড়িত তা তদন্তের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসবে। যেহেতু ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত চলছে তাই এ বিষয়ে আর বিশেষ কিছু বলা যাচ্ছে না।‘
‘জীবন বাঁচাতে ফাঁড়িতে টাকা নিয়ে আসতে বলেছিলেন রায়হান’
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রতিদিনের মতো গত শনিবার বিকেল ৩টায় রায়হান আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটস্থ ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রাণীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হয়। তখন তাঁর ফোন বন্ধ পায় পরিবার। ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তাঁর মায়ের কাছে ফোন দেয়। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাঁকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন।
রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, ‘পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাঁকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখতে পায়।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’