পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও নেশায় গীতিকার-সুরকার-শিল্পী
দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত জীবন। নুন আনতেই পান্তা ফুরানোর সংসার তাঁর। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার গণ্ডিও প্রাথমিক অবধি। এতো শূন্যতার মধ্যেও প্রশংসনীয় প্রতিভার অধিকারী তিনি। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি হলেও, নেশায় তিনি একজন স্বভাব কবি। বলছিলাম, শিল্পী বিজয় চন্দ্র বান্ধবীর কথা। অসম এক প্রেমের কারণে আজ যিনি পরিণত হয়েছেন গীতিকার-সুরকার-শিল্পী রূপে।
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের নাপিতেরচর গ্রামের বাসিন্দা বিজয় চন্দ্র বান্ধবী। গ্রামের রাস্তার মোড়ে ছোট্ট একটি টিনের চালাঘরে তাঁর কাঠের আসবাবপত্র তৈরির দোকান। সারাদিন কাঠ কাটা আর পেরেক ঠোকা যার কাজ। তাও ধনীর ঘরের দামি কোনো আসবাব নয়, তৈরি করেন গরিবের ফরমায়েসি চৌকি, আলমারি, আলনা ইত্যাদি।
এমন কঠিন কাজের মধ্যেই বসে কিংবা দাঁড়িয়েই লিখে যাচ্ছেন কবিতা আর গান। ঘরের এক কোণে রাখা হারমোনিয়াম বাজিয়ে তুলছেন সুরও। নিজের কণ্ঠে তোলার পর গ্রামের অখ্যাত শিল্পীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সেসব গান-কবিতা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিনে পয়সায়, কেবল হাত তালির বিনিময়ে পরিবেশন হয় তাঁর লেখা গান-কবিতা।
বিজয় চন্দ্র বান্ধবীর লেখালেখির শুরু কৈশোর থেকে। প্রায় ২৩ বছর ধরে তিনি গান লিখে আশেপাশের মানুষের বিনোদন জুগিয়ে যাচ্ছেন। পাচ্ছেন বাহবা।
বিজয় চন্দ্র বান্ধবী লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, যেমন লিখেছেন-
তুমি যদি পাও গো ব্যথা
আমি সহিবো কেমনে
আমি দুঃখ নিয়ে পড়ে আছি
তুমি সুখী হবে জেনে।
এই ভবের বাজারে
মানুষ আইলো গেলো রে,
কেউ চিরদিন থাকতে পারলো না
এই ভীষণ আজব ঘটনা॥
মনের ব্যথা যাই না দেখা
যাই না দেখা জ্বালা,
দেখাই কারে বুকটা ছিড়ে
অন্তর পুড়ে কালা॥
আমি কেমনে রইবো মাটির ঘরে
নেইতো আলো অন্দরে
আপন জনের মায়ার বাঁধন
ভাবলে কাঁদে দুটি নয়ন
আসব না আর ফিরে॥
আমার পৃথিবীর আঁধারে ঢাকা
আমার পৃথিবীতে আমিই একা
তোমার জীবনে হাসি গানে
দুটি চোখে তোমার স্বপ্ন আঁকা॥
আঁচলে তাঁর মুখটা ঢাকা
দুটি হাতে জোড়া শাখা
দূর থাকিয়া দেখা যায়
নৌকাতে চড়িয়া বধূ যায়
বধূয়া যায় যায়রে
নৌকাতে চড়িয়া বধূয়া যায়॥
এমন সব চমৎকার বিরহ ও আধ্যাত্মিক গান লিখে যাচ্ছেন বিজয় চন্দ্র বান্ধবী। এ পর্যন্ত দুই হাজার কবিতা ও পাঁচ হাজারেরও বেশি গান তিনি রচনা করেছেন।
বিজয় চন্দ্র বান্ধবী জানান, তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকাকালে বাবা মনোরঞ্জন চন্দ্র বিশ্বাস মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মা সুশীলা বালা ছোট সন্তানদের নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। তখন সংসারের হাল ধরতে শিশু বিজয়কে হাতে তুলে নিতে হয় কাঠমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি।
বৃদ্ধ মা, স্ত্রী সীমা বালা আর দুই মেয়ে নিয়ে বিজয়ের সংসার চলছে এখন। প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে লড়তে হচ্ছে চরম দরিদ্রতার সঙ্গে। এরপরও এই স্বভাব কবি লিখে যাচ্ছেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে সুর করছেন। গেয়েও যাচ্ছেন।
নামের শেষে ‘বান্ধবী’ কেন লাগালেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মুচকি হেসে, লাজুক ভঙ্গিতে বিজয় চন্দ্র জানালেন, এমন নামের সঙ্গে কিশোর বয়সের এক অমর প্রেমগাঁথা জড়িয়ে আছে। লুকিয়ে আছে বিরহ, বিচ্ছেদ। তাঁর লেখক হয়ে ওঠার অনবদ্য কাব্যিকতা গেঁথে আছে। যে বান্ধবী প্রেমের বীজ হৃদয় জমিনে পুঁতে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন স্বপরিবারে। সেই ললনার বিরহে দগ্ধ বিজয়ই আজকের এই বিজয় চন্দ্র বান্ধবী।
বিজয়ের ভাষায় ‘সে আমাকে ফেলে ভিনদেশি হলেও, আমি তাকে ধারণ করেছি আমার অস্থি-মজ্জা আর মননে। শক্ত পেরেকে ঠুকে রেখেছি নামের সঙ্গে জড়িয়ে। সে নিয়েছে সামান্যই, দিয়েছে অনেক। তাঁর দেওয়া সম্পদই প্রতিদিন আমার ভেতর থেকে নিংড়ে পড়ছে।’
এমন বিরল মেধা আর মননের চর্চা নিয়ে তাঁর প্রত্যাশা কী? এমন প্রশ্নে বিজয় চন্দ্র জানান, ভালো গণমাধ্যমে তাঁর এসব সৃষ্টি উঠে আসুক গুণীদের কণ্ঠে। আর সরকারি সহায়তায় যদি তাঁর দরিদ্রতা কিছুটা হলেও লাঘব হয়।
বিজয়ের প্রত্যাশার মতোই স্থানীয় লোকজনের চাওয়া একই। সবাই চায় এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে তাদের এই বিজয়ের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। সারা দেশের সরকার, মিডিয়া কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইউসুফ, পাশের উপজেলা বেলাব প্রেসক্লাবের সভাপতি শেখ আবদুল জলিল, পরিচালক-প্রযোজক ও অভিনেতা মো. দিদার হোসেন পিন্টু, ভৈরবের স্থানীয় দৈনিক পূর্বকণ্ঠের উপসম্পাদক মিলাদ হোসেন অপু।
এদিকে বিজয়ের গান গেয়ে এবং বহু গান নিজে সুর করে আঞ্চলিকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বাসিন্দা শিল্পী মকবুল হাসান রজনী। তিনি জানান, তিনি যদি সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলে বিজয়ের গান গাইতে পারতেন, তাহলে বিজয়কে বড় পরিসরে তুলে ধরা যেত।
বিজয়ের মা সুশীলা বালা জানান, বিজয়ের লেখা গান-কবিতা গ্রামের অন্য মানুষের মতো তাঁরও বেশ ভালো লাগে। তিনি ছেলের এই প্রতিভাকে বিকশিত হতে সরকারের সহায়তা কামনা করেন।
সুশীলা বালা আক্ষেপ করে জানান, তাঁর বয়স বর্তমানে আশির ওপরে। মৃত্যুর আগে ছেলের এই প্রতিভার বিকাশ দেখে যেতে পারলে তিনি শান্তিতে মরতে পারতেন।
স্বামীর প্রতিভায় মুগ্ধ স্ত্রী সীমা বালাও। তিনিও চান তাঁর স্বামীর দেশজোড়া নাম-ডাক হোক। দূর হোক সংসারের দরিদ্রতা। সুযোগ পেলেই তিনি তাঁর স্বামীর লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন বলেও জানালেন।