ফেসবুকে প্রেমের পর ধর্ষণ, রেহাই পায়নি কেউ!
পড়াশুনা করেছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু পরিচয় দিতেন স্নাতকোত্তর পাস বলে। কাজ করতেন ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির। পরিচয় দিতেন অবস্থাপন্ন ধনী পরিবারের সন্তান হিসেবে। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী এবং বয়স্ক নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলতেন। এরপর বিভিন্ন এলাকা ও হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করতেন। সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকার ‘আমারী রিসোর্টে’ এক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছেন।
এই অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা সাগর মিজিকে (২৪) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১০-এর সদস্যরা। আজ শনিবার রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর এ নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব।
র্যাব-১০-এর অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মাহফুজুর রহমান বলেছেন, ‘সাগর মিজি প্রকৃতপক্ষে একজন লম্পট। আমরা ভেবেছিলাম, সাগর সিরিয়াল কিলার। কিন্তু এখন আমরা দেখছি, তিনি সিরিয়াল রেপিস্ট।’
মাহফুজুর রহমান বলেন, আসামি সাগর মিজি গত ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকার ‘আমারী রিসোর্ট’-এর ১০৮ নম্বর রুম ভাড়া নেন। হোটেল কর্তৃপক্ষকে তিনি জানান, ২০ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী ঢাকা থেকে এখানে আসবেন, তখন তাকে অন্য একটি ডাবল রুম দিতে হবে। সে মোতাবেক ২০ সেপ্টেম্বর সাগর তার স্ত্রীর পরিচয়ে নিহত হওয়া নারীকে নিয়ে ৪০৮ নম্বর রুমে ওঠেন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘পরে ২১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ ওই কক্ষে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ভেঙে ওই নারীর রক্তাক্ত মরদেহ দেখতে পান। এরপর পুলিশকে খবর দেয় কর্তৃপক্ষ। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। এরপর এ ঘটনায় একটি মামলা হয়। তারপর থেকে আমরা সাগরকে ধরতে অভিযান চালাই। সর্বশেষ আজ সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড টোলপ্লাজা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করি। সে সময় তার কাছ থেকে ভুক্তভোগীর মুঠোফোনসহ মোট তিনটি মুঠোফোন ও নগদ ১৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।’
মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষত ফেসবুকে সাগরের ফেইক (ভুয়া) অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি কিশোরী থেকে শুরু প্রাপ্তবয়স্ক নারীদেরও প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন এবং জোরপূর্বক ধর্ষণ করতেন। কেউ যদি বাধা দিতেন, তাহলে তাদের তিনি শারীরিকভাবে আঘাত করতেন।’
‘আমারী হোটেলে ধর্ষণের পর হত্যাও তেমন একটি ঘটনা। ২০ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনা আমরা যতটুকু জেনেছি, সাগর যখন ওই নারীকে ধর্ষণ করতে থাকেন, তখন নারী তাকে বাধা দেন। একপর্যায়ে সাগর ভুক্তভোগী নারীকে গলা চেপে ধরে দেয়ালে আঘাত করেন। এরপর ওই নারী নিচে পড়ে যান। পড়ে যাওয়ার পর নারীর মাথায় পাশে থাকা গ্লাস দিয়ে দুই-তিনবার আঘাত করেন। সে সময় নারীর মৃত্যু নিশ্চিত করে সাগর পালিয়ে যান।’
র্যাবের দাবি, ‘আমরা জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি, সাগর চতুর্থ শ্রেণি পাস হলেও তিনি নিজেকে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস বলে পরিচয় দিতেন। এসব তথ্য তার ফেসবুকের মেসেঞ্জারেও আমরা দেখেছি। প্রকৃতপক্ষে সাগর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতেন। সেখানেই তার বাড়ি। সাগরের বাবাও হতদরিদ্র। পারিবারিক অবস্থাও ভালো না। অথচ তার ফেসবুকে কথা-বার্তার সঙ্গে এসবের কোনো মিল নেই। ফেসবুকে তিনি খুবই সিদ্ধহস্ত।
আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আমরা সুনিশ্চিতভাবে পাঁচজনের ঘটনা জানি, যাদেরকে সাগর প্রলুব্ধ করে পরবর্তীতে ধর্ষণ করেন এবং শারীরিকভাবে আঘাতও করেন।’
‘এর মধ্যে একই পরিবারের দুই বোনও আছে। আমাদের ধারণা ও তার ফেসবুক অ্যানালাইসিস করে দেখেছি, তিনি এভাবে ১০ থেকে ১২টি ঘটনা ঘটিয়েছে। এমনকি তার বেশিও হতে পারে। নারীদের মিথ্যা প্রেমের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করতেন সাগর। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে নিয়ে কৌশলে জোরপূর্বক ধর্ষণ করতেন।’
মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন, তার (সাগর) বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় দণ্ডবিধি ৩০২ ও ৩৪ ধারায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসে আমাদের কাছ থেকে সাগরকে বুঝে নিয়ে যাবেন।’
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘ভার্চুয়াল জগত ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীরাও আছেন। সাগরের সঙ্গে এমন তরুণীদের কথোপকথনও দেখেছি। এটা খুবই শঙ্কার বিষয়। এ ধরনের সিরিয়াল রেপিস্টদের কাছ থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
আপনি বলেছেন, সাগরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কি কোনো থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা মামলা করা হয়েছে, এমন প্রশ্নে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এসব ঘটনার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এবং আমরা তার কাছ থেকেই এসব জেনেছি। কিন্তু, এখন পর্যন্ত এসব ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি বলে আমরা জেনেছি। এখানে আত্মসম্মানের ব্যাপার আছে, সামাজিক বিষয়সহ পারিবারিক বিষয় রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা ভুক্তভোগী তারা কিন্তু মামলা করতে চান না।’
কক্সবাজারের নিহত ওই নারীর সঙ্গে সাগরের পরিচয় কীভাবে হয়েছিল, এমন প্রশ্নে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের পরিচয় হয়। এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি, তার তিনটি ফেইক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তার একটি অ্যাকাউন্ট ছিল, যেটি নারী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে নারীদের কাছাকাছি যেতেন।’