ফেসবুক লাইভে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা : কার দায় কতটা?
ফেসবুক লাইভে নানা হতাশার কথা জানিয়ে গত বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে এভাবে আত্মহত্যার ঘটনায় কার কতটা দায়, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমজুড়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন কিংবা বিশেষজ্ঞদের জবানিতে উঠে এসেছে সমাজের বাস্তবচিত্র। আমাদের পারিবারিক বন্ধন কিংবা সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও এসেছে সামনে। কেউ বলছেন, এ ধরনের ঘটনায় বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সমাজে। বিষণ্নতায় থাকা মানুষ উৎসাহ পেতে পারেন আত্মহননের পথে।
আবার সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘যে যাই বলুক, আত্মহনন কোনো সমাধান নয়। জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি। ফলে, যেকোনোভাবে বেঁচে থাকার নামই জীবন বা জীবনযুদ্ধ। কিন্তু, জীবনের প্রতি হতাশা কিংবা বিতৃষ্ণায় থাকা এসব মানুষের প্রতি সমাজের, রাষ্ট্রের কিংবা পরিবারের দায়ও রয়েছে।’
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ ধরনের ঘটনা কিন্তু এই একটি নয়, গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ফেসবুক লাইভে এসে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন পূবাইলের মধ্যবয়সী স্বপন চন্দ্র দাস নামের এক ব্যবসায়ী। ১৭ আগস্ট মৌলভীবাজারে সুমন নামের এক জাদুশিল্পী ফেসবুক লাইভে এসে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরে একইভাবে চুরির দায়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালত ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন এক যুবক। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর সিলেটে এক তরুণ আত্মহত্যা করেন ফেসবুক লাইভে। সর্বশেষ মৃত্যুবরণ করেন আবু মহসিন খান। তাই সমাজের সচেতন মহল ও সমাজবিজ্ঞানীদের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। তারা বলছেন, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করাই এই অপমৃত্যু থেকে বাঁচার একমাত্র পথ।
গত বুধবারের আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ফেসবুক লাইভের ভিডিওটি শুধু দেশে নয়, ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। যা নিয়ে এখন আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
মহসিন খানের আত্মহত্যার পর ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে না দিতে অনুরোধ জানিয়ে আল আমিন নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘দয়া করে আমার বা আপনার সন্তান বা স্বজনকে আত্মহত্যা করতে উৎসাহিত করবেন না। আমার ভয় হচ্ছে। ভিডিওটি দেখার পর নিজেকে অসুস্থও মনে হচ্ছে। দয়া করে ভিডিওটি কেউ শেয়ার করবেন না।’
শুধু আল আমিন নয়, এমন আরও অনেকে ভিডিওটি শেয়ার করতে নিরুৎসাহিত করলেও তা তেমন কাজে আসেনি। এমনকি আবু মহসিন খানের ফেসবুক থেকে ভিডিও মুছে দেওয়া হলেও তা ডাউনলোড করে মানুষকে শেয়ার করতে দেখা গেছে। যদিও ছয় ঘণ্টার মধ্যে ওই ভিডিওটি সরিয়ে নিতে বলেছিলেন হাইকোর্ট।
বিষয়টি নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ফেসবুক লাইভে এসে আবু মহসিন খান আত্মহত্যা করে হয়তো সমাজের কাছে তাঁর একাকিত্ব ও হতাশার বার্তা দিতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন নানান অসঙ্গতির কথা। তিনি হয়তো ইতিবাচক মনোভাব থেকে কাজটি করেছেন কিন্তু তা ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এমন হতাশাগ্রস্ত অনেক মানুষ তো তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রাণিতও হতে পারে। তিনিও যদি এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন? তাহলে এটা কী ঠিক কাজ হল? তবে, এখানে আমাদের অনেক দায় রয়েছে। মানসিক অবস্থা নিয়ে কাজ করার ফলে প্রথম দায়টি আমার। এ ছাড়া গণমাধ্যমেরও দায় রয়েছে। কারণ, গণমাধ্যমের আত্মহত্যা বন্ধে ভূমিকা রাখা উচিত। আর রাষ্ট্রের দায় তো আছেই।’
ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এত কনটেন্ট বন্ধ করে দিতে পারে, এটা কেন বন্ধ করল না? ওই ব্যক্তি তো আত্মহত্যা করার বেশ আগেই জানিয়েছিলেন তিনি আত্মহত্যা করবেন। ফলে, ফেসবুক চাইলে ভিডিওটির সম্প্রচার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিতে পারত বা ফেসবুকের এ ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে অটোমেটিক প্রসেস থাকা উচিত, যা অটোই ডিলেট বা রিমুভ করে দেবে। তা যদি না থেকে থাকে, তা হলে এখন এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। এখানে সমাজের, রাষ্ট্রের এবং আমাদের পাশাপাশি ফেসবুকেরও দায় রয়েছে।’
ডা. মেখলা সরকার আরও বলেন, ‘এই আধুনিক সভ্যতায় আমরা এখন পরিবার বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। এমন প্রেক্ষাপটে যদি কোনো ব্যক্তির সঙ্গ দেওয়ার কেউ না থাকেন এবং সেজন্য যদি তিনি আত্মহত্যার মতো প্রাণঘাতি চিন্তা করতে থাকেন, সেখানে কিন্তু আমরা যারা মানুষের মানসিক অবস্থা নিয়ে কাজ করি, তাদের কিন্তু বিরাট ভূমিকা রয়েছে। যে ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি যদি কোনোভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে তার মানসিক অবস্থার উন্নতি হতে বাধ্য। তিনি আস্তেধীরে নিজেকে নির্ভার করে ফেলতে পারবেন। ফলে, এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার হতে পারে। যাতে একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষ জানতে বা বুঝতে পারেন, কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।’
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন এ বিষয়ে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পারিবারিক বা সামাজিক জীবনে মানুষের বিচ্ছিন্নতা থাকতে পারে, তার জন্য আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। বরং, নিজের মনকে সজীব করে বেঁচে থাকার নামই জীবন। বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে। এটাই জগতের নিয়ম। ফলে, এর মধ্যে থেকেও আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছু থাকে, একটি বা দুটি দিক না থাকলে কিন্তু তাঁর সব অবলম্বন শেষ হয়ে যায় না। আর একটি বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা কিন্তু একদিনে ঘটে না। এর আগে তাঁর প্রিয়জন, চিকিৎসক কিংবা স্বজনদের কিন্তু বুঝতে পারার কথা। ফলে, আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান, অপরাধবিজ্ঞানী খন্দকার ফারজানা রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের কাজের অ্যাবিলিটি যেহেতু একটু কম থাকে, সেহেতু তারা নানা বিষয়ে ইমোশোনাল হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে পরিবারের একটি বড় দায়িত্ব। যেটি আবু মহসিন খানের ক্ষেত্রে করা হয়নি। লাইভে এসে আত্মহত্যার বেশ আগেই জানিয়ে দিলেন, তিনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন। খেয়াল করেন, কেউ একজন তাঁকে ফোন দিলেন না। ফোনটি তখনই এলো, যখন তাঁর আত্মহত্যা করা ইতোমধ্যে শেষ। এটা তো আমার কাছে ভয়ঙ্কর বিষয় মনে হলো। এ ছাড়া এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কিন্তু ভূমিকা থাকতে পারত। লাইভে আত্মহত্যার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা চলে যেতে পারত। তাহলে হয়তো তিনি বেঁচেও যেতে পারতেন।’
খন্দকার ফারজানা রহমান আরও বলেন, ‘দেশের আইনকানুন বা পেনাল কোড অনুযায়ী আত্মহত্যা একটি অপরাধ। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে সেভাবে দেখি না। অপরাধবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি, ধর্মীয় বিশ্বাস, কমিটমেন্ট, সোশ্যাল ইনভলভমেন্ট ও পারিবারিক অ্যাটাচমেন্ট থাকলে সমাজে আর অপরাধ থাকে না।
এদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সুইসাইড একটি অপরাধ হলেও খেয়াল করে দেখেন, যখন একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন; তখন পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা নেয়। পুলিশ তদন্ত করে যখন দেখেন, ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন তখন মামলা ডিসমিস। কিন্তু, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা পুলিশের উচিত এ বিষয়ে তদন্ত করা। এ আত্মহত্যার কারণ কী, কারা তাঁকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করছে, সেগুলো খুঁজে বের করা। এগুলো নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু প্রায়ই ঘটছে। আগে হতো গোপনে, এখন মানুষ প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করছে। ফলে, এ ব্যাপারে প্রয়োজনে গবেষকদেরও যুক্ত করা উচিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘লাইভে এসে এ আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে অনেকগুলো বিষয় ফুটে উঠেছে। সামাজিক বাস্তবতা, সম্পর্ক, পরিবার কিংবা পরস্পর কীভাবে আমাদের সম্পর্কগুলো বাস্তবায়ন করছি, সেসব বিষয়গুলো সামনে এসেছে। এর আগে তিন-চারজন এভাবে লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন। এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষ যখন সামাজিক ও পারিবারিক জীবন নিয়ে এক ধরনের চাপ অনুভব করেন এবং যখন তিনি কোনোভাবে কাউকে মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারেন না; তখন তাঁর যাপিত জীবনের ওপর এক ধরনের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। তখন তিনি আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেন। অনেক দেশে আত্মহত্যাকে ব্যক্তির অধিকার হিসেবে ধরা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা সম্ভব না। আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায়ও সেটা সম্ভব না। সুতরাং, সামাজিক বা পারিবারিক সম্পর্কের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিই, কিন্তু সামাজিক প্রবৃদ্ধির ওপর নজর দিই না। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি আত্মহত্যা কমাতে বা এ ধরনের মানুষকে সহযোগিতা করতে রাষ্ট্রেরও অনেক ভূমিকা রয়েছে। সেখানে গণমাধ্যমেরও অনেক ভূমিকা থাকতে পারে। নানাভাবে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রের সে ধরনের সক্ষমতা রয়েছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে তা বাড়াতে হবে।’