বহু শিক্ষার্থীকে স্কুলে ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কা
করোনায় দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত খুশি এনে দিতে পারছে না অসংখ্য শিশুর মনে। কারণ, করোনায় সৃষ্ট দরিদ্রতায় এসব শিশু বই রেখে পুরোদমে কর্মজীবী শিশুতে পরিণত হয়েছে। আবার, এত দিন পর স্কুল খোলামাত্রই আগের নিয়মে যদি পড়ালেখার চাপ তৈরি করা হয়, তাহলে তা শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর স্কুল খুলে দেওয়ার খবরে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী আনন্দে আছে। আরেক শ্রেণির শিক্ষার্থী আছে কষ্টে। কারণ তারা জানে না, স্কুলে আদৌ যেতে পারবে কি না। তাদের কাছে এখন টিকে থাকার সংগ্রামই মুখ্য।
ধরা যাক বগুড়া সদরের একটি গ্রামের শিশুদের কথাই। করোনার আগে তারা স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। আর এখন, অভাব এবং দীর্ঘদিন করোনায় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তারা চায়ের দোকানের নিয়মিত শ্রমিক। এসব শিক্ষার্থী বলছে, তাদের স্কুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, তাদের কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
তাদের বাস্তবতা আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য যোগাযোগ হয় অভিভাবক এবং স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে।
কর্মজীবী এক অভিভাবকে জানান, তিনি দোকানে কাজ করেন। রোজগার কখনও হয়, আবার কখনও হয় না। এজন্য সন্তানদের কাজে যেতে বলছেন।
বগুড়ার জোড়গাছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাজু মিয়া বলেন, ‘শিক্ষক-কর্মচারীদের যথাসাধ্য চেষ্টার পর কিছু শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনা গেলেও, শতভাগ ফিরিয়ে আনা কখনোই সম্ভব নয়।’
সারিয়াকান্দির চর খাজিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সবুজ বলেন, ‘আমরা অভিভাবকদের বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি, তাঁরা যেন তাঁদের সন্তানদের স্কুলমুখী করেন এবং তাঁরা যেন সন্তানদের কাজে না পাঠান।’
একই চিত্র দেখা গেল কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি এলাকায়। এগার বছর বয়সী সোহান পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখন অন্যের বাড়িতে শিশু শ্রমিকের কাজ করছে। এর কারণ একটাই—পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা। আর্থিকভাবে বাবাকে কিছুটা সহায়তা দেওয়ার জন্যই অন্যের বাড়িতে কাজ করছে সোহান। দেশের উত্তরাঞ্চলের শিশুদের বেলায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।
বিগত বছরগুলোতে এ সময় শিশু শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে যাওয়া-আসা ও খেলাধুলা করে ব্যস্ত সময় কাটালেও, এক বছরের বেশি সময় ধরে মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
অন্য দিকে, করোনার কারণে উপার্জন কমে যাওয়ায় ফুলবাড়ির হতদরিদ্র পরিবারগুলো শিশুদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করছে। এতে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা কম পারিশ্রমিকে শিশুদের নানা কাজে যুক্ত করছেন। এতে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা বাড়বে বলে অভিমত শিক্ষকসহ সচেতন মহলের।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান। ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়ার বটতলা এলাকার দিন মজুর ইস্রাফিল আলমের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে মিজানুর রহমান বড়। ছেলের স্কুল বন্ধ থাকায় পরিবারের আয় বাড়াতে তাকে কালিরহাট বাজারের একটি চায়ের দোকানে দৈনিক ১০০ টাকা মজুরির বিনিময়ে কাজে নিয়োজিত করেছেন।
মিজানুর বলে, ‘আমি কালিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় এক মাস ধরে চায়ের দোকানে কাজ করছি। এখানে মালিক দুই বেলা খাওয়া দেয়। এ ছাড়া মজুরি হিসেবে দৈনিক ১০০ টাকা দেয়। আমার উপার্জনের টাকা বাবার হাতে তুলে দিই। স্কুল খুললে স্কুলে যাব।’
মিজানের বাবা ইস্রাফিল আলম বলেন, ‘বাহে, আমরা খুবই গরিব মানুষ। করোনার কারণে আয় কমে গেছে। তাই ছেলেটাকে মানুষের দোকানে রেখে দিয়েছি। স্কুল খুললে স্কুলে পাঠানো হবে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার সীমান্তবর্তী নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের একটি গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী এরশাদুল বাদাম বিক্রি করছে। সে জানায়, সংসারে দিনমজুর বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সব সময় তাঁর কাজ থাকে না। তাই সে বাদাম বিক্রি করছে। দিনে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে যাবে কি না, জানতে চাইলে সে জানায়—যাবে। এরশাদুলের বাবা মজিবর রহমান বলেন, ‘এক জনের আয়ে সংসার চলে না। ছেলের স্কুল বন্ধ। তাই ছেলেকে কাজে লাগিয়েছি।’
উপজেলার বালারহাট বাজারে দেখা গেছে, বাঁশের তৈরি কুলা বিক্রি করছে বালারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহাগ। বাবা ফজর আলীর মাছের দোকানে মাছ বিক্রি করছে নলডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র রুবেল মিয়া। আর, পাশেই মামা সাহেব আলীর মাছের দোকানে মাছ বিক্রি করছে কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র খাজা মইনউদ্দিন।
ফুলবাড়ী জছিমিয়া সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ায় নিম্ন-আয়ের মানুষের উপার্জন কমে গেছে। এজন্য অনেকেই তাঁদের স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের বাড়তি আয়ের আশায় কাজে দিচ্ছেন। এসব শিশুদের বিভিন্ন পেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকসহ অভিভাবকদেরও বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। না হলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে।
শিশু শিক্ষার্থীদের অর্থ উপার্জনে জড়ানোর বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এরশাদুল হক বলেন, ‘বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকেরা আমাকে জানাননি। কোনো শিশু যদি শিশুশ্রমে নিয়োজিত থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে মনিটরিং করে তাদের ফিরিয়ে আনা হবে।’
অন্য দিকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুর রহমান জানান, বিষয়টি শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মনিটরিং করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিশুদের স্কুলে ফেরার বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী। স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সব ছাত্রছাত্রীকে আবার শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনতে স্কুল শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাজ করতে হবে। বিষয়টি যথাযথভাবে মনিটরিং করতে হবে।’
অন্তত অর্ধেক শিশুকে আবারও স্কুলে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ইনস্টিটিউট থেকে বলা হয়েছে, করোনায় সৃষ্ট অভাবই যদি স্কুলে না আসার কারণ হয়, তাহলে সে অভাবকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. তাপস কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘তাদের (শিশু ও তার পরিবার) আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা দরকার, যেহেতু আর্থিক সমস্যার কারণে তারা (শিশুরা) স্কুলে আসতে পারছে না। যার যে সমস্যা, সেটিই আগে পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া কোনো পরিবারকে যদি সচেতন করতে হয়, তাহলে শিক্ষকেরা তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলবেন।’
তাপস কুমার বিশ্বাস আরও বলেন, ‘আমরা স্বাভাবিকভাবে এর আগে দেখেছি যে, অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে যেত। এখন হয়তো সেটা বেড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হতে পারে।’
বিদ্যমান বাস্তবতায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। করোনার বিশেষজ্ঞদের যে পরামর্শক কমিটির পরামর্শে স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেই কমিটির প্রধানের মতে, স্বাস্থ্যবিধি সর্বোচ্চ মানাসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর রাখা অত্যন্ত জরুরি।
এ ছাড়া স্কুল খুলে দেওয়ার আগে আরও যে আশঙ্কা সামনে চলে এসেছে, তার মধ্যে একটি শিশুদের শিক্ষার মনস্তত্ত্ব নিয়ে। শিক্ষা মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষা মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব।
শিক্ষা মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘দীর্ঘদিন তারা (শিশুরা) স্কুলে আসেনি। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের যে প্র্যাকটিস, সেটি পরীক্ষাভিত্তিক পড়ালেখার প্র্যাকটিস। শিক্ষকদের মাথার মধ্যেও এটা আছে। অভিভাবকদের মধ্যেও সেই আকাঙ্ক্ষা আছে। আমি যেটি আশঙ্কা করছি—স্কুল খোলার পরে সবাই খুব তাড়াহুড়ো করবে বেশি বেশি শেখার জন্য। বাচ্চাদের বেশি বেশি চাপ দেওয়া হবে। এটা একটা আশঙ্কা যে, শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিকভাবে চাপ পড়বে।’
এ রকম নানা বাস্তবতা আর চ্যালেঞ্জের মধ্যে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যেন শেষ পর্যন্ত সফল হয়, সেটিই প্রত্যাশা সবার।