‘বাবা পা উড়ে গেছে, আমাকে কালেমা পড়ে দেন’
চারপাশে কান ফাটানো আওয়াজ। বিকট শব্দে ক্ষণে ক্ষণে বিস্ফোরণ হচ্ছিল। এর পরই দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। তারপর হঠাৎই আরও জোরালো একটি বিস্ফোরণ। তার তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে, আশপাশের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। যেন ভূমিকম্প হয়েছে। সেই বিস্ফোরণের শব্দে অনেক বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙে যায়। এমন ভয়াবহ সময়ে আহত হন চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম কনটেইনার ডিপোতে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া মমিনুল। ওই বিস্ফোরণে তাঁর এক পা উড়ে যায়।
সেই ক্ষতের তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে কোনো রকমে বাবাকে ফোন করেন মমিনুল। ফোনে বাবাকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা কিছুক্ষণ পর পর এখানে বিস্ফোরণ হচ্ছে। আমার পা উড়ে গেছে। তারপরই ফোনটা কেটে যায়। ফোনে হঠাৎ ছেলের আর্তনাদ শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বাবা ফরিদুল হক।’
এরপরও ছেলের কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় ফোন কানে ধরে রাখেন অনেকক্ষণ। কিন্তু না, লাইন কেটে যাওয়ার পর আর ছেলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয়নি ছেলে ফরিদুলের।
এর কিছুক্ষণ পরেই টিভিতে দেখতে পান ছেলে মমিনুল যেখানে আছেন, সেখানকার বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। শঙ্কায় পড়েন—পা উড়ে যাওয়া ছেলের জীবনটা আছে তো? তখনো ফরিদুল জানতেন না, পা হারানোর পর প্রাণটাও হারিয়েছেন মুমিনুল। ফরিদুল জানান, মৃত্যুর আগে মমিনুল তাঁকে কালেমা পড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন।
মমিনুলের বাবা ফরিদুল এনটিভিকে বলেন, ‘ফোনেই সে (ছেলে) চিৎকার করে বলছিল—বাবা এখানে কিছুক্ষণ পরে পরে ব্লাস্ট হচ্ছে। দ্বিতীয়বার ফোন করে মমিনুল বলেছিল, বাবা আমার একটা পা উড়ে গেছে। আমাকে কালেমা পড়ে দেন। এটাই আমার সঙ্গে তার শেষ কথা।’
বাবা ফরিদুল হক জানান, এই ঘটনার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মমিনুলের চাচা খোরশেদ আলম হাসপাতালে গিয়ে তাঁর ভাতিজার মরদেহ দেখতে পান।
মমিনুলের খালাতো ভাই তায়েব জানান, চাকরি করে স্নাতকোত্তর করবেন বলে আশা ছিল মমিনুলের। মমিনুল গতকাল শনিবার রাত ৮টায় ডিপোতে যান। রাত ৯টার সময় ফোন করে বলেন, ভাই আমাকে বাঁচা। পরে হাসপাতালে এসে দেখি ভাই আর বেঁচে নেই।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। সময় যত গড়াচ্ছে ততই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের আট উদ্ধারকর্মী রয়েছেন। নিহতের এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে আজ রোববার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ প্রায় ২০ ঘণ্টা পরও ঘটনাস্থলে জ্বলছে আগুন। বন্ধ হয়নি বিস্ফোরণ। তবে, উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবহিনী।
বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জন হওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নির্বাপণ হয়নি। আগুন যেন এই এলাকার বাইরে সমুদ্র এলাকায় যেতে না পারে, সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনও বিস্ফোরণ ঘটছে এবং কনটেইনারের ভেতরে আগুন জ্বলছে। একইভাবে উদ্ধারকাজও চলছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশসহ বিশেষ টিম কাজ করছে। তবে, আগুন ডিপো এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।