বিখ্যাত হওয়ার ‘খায়েশে’ চিকিৎসকের ‘প্রতারণার ভুবন’
বস্তুত ইশরাত রফিক ঈশিতা একজন চিকিৎসক। কিন্তু, এর বাইরেও তিনি নিজেকে কখনো সেনাকর্মকর্তা, কখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গবেষক, বিশিষ্ট আলোচক, দূত ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচয় দিতেন।
২০১৩ সালে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা ঢাকার দোহারের মেয়ে ঈশিতার বয়স খুব বেশি না হলেও দেশ-বিদেশের অসংখ্য ‘ডিগ্রি’ আছে তার। এমনকি বিদেশ থেকে তিনি ৪০০ ডলারের বিনিময়ে ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ পদবিও কিনে নিয়েছিলেন, নিজেকে বানিয়ে ফেলেছিলেন সামরিক কর্মকর্তা! ডিগ্রি যে শুধু তিনি নিজেই নিতেন তাই না। তিনি ডিগ্রি বিলাতেনও। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, চিকিৎসকের ডিগ্রি ছাড়া ঈশিতার বাকি সবই ভুয়া। তিনি বিখ্যাত হওয়ার খায়েশে প্রতারণার এক ভিন্ন নজির স্থাপন করেছেন।
ইশরাত রফিক ঈশিতা সম্পর্কে অসংখ্য প্রতারণার তথ্য জেনে আজ রোববার সকালে মিরপুর-১ নম্বর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ সময় তার সহযোগী শহীদুল ইসলাম দিনারকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে দুজনকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে চিকিৎসক ঈশিতা সম্পর্কে এসব তথ্য তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এ সময় তিনি বলেন, ঈশিতার এই মিথ্যা ও প্রতারণায় ভরা তথাকথিত সাফল্যের গল্প সত্য ভেবে দেশের প্রথম সারির বহুল জনপ্রিয় কিছু গণমাধ্যমও প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করেছে। এসব প্রতিবেদনকে ঈশিতা নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানো ও প্রতারণা কাজে ব্যবহার করতেন।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, গ্রেপ্তারের সময় ঈশিতার কাছ থেকে অসংখ্য ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সিল, ভুয়া সার্টিফিকেট, ভুয়া প্রত্যয়নপত্র, ভুয়া পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০ ইয়াবা, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ এবং মোবাইল জব্দ করেছে র্যাব।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ইশরাত রফিক ঈশিতা নামের এই চিকিৎসক নিজের গগনচুম্বী ভুয়া সাফল্য ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারে লিপ্ত ছিলেন। এগুলো করে তিনি মূলত সুনাম অর্জন ও সুনামকে ব্যবহার অবৈধভাবে অর্থ উপর্জন করতেন। এসব তথ্য ঈশিতাই জিজ্ঞাসাবাদে আমাদেরকে জানিয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঈশিতা ময়মনসিংহে অবস্থিত একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হতে ২০১৩ সালে (সেশন ২০০৫-২০০৬) এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালের জুনের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। একই বছর তিনি একটি সরকারি সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে চার মাস চাকরি করার পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকরিচ্যুত হন ঈশিতা।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ইশরাত রফিক ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র্যাংক ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। সে ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট (IPC.Phil.com) থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর মতো ‘বিগ্রেডিয়ার জেনারেল’ পদটি প্রাপ্ত হন বলে জানান। এ ছাড়া তিনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অরগানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অরগানাইজেশন ইত্যাদি সদস্যপদের ভুয়া সনদ তৈরি করে প্রচারণা চালাতেন।’
‘বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী’র তকমা
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ঈশিতার ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডিগ্রিগুলো যথাক্রমে- এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি। এ ছাড়া ভুয়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তিনি বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করে থাকেন। শুধু তাই নয়, ঈশিতা ১৫ থেকে ২০টি জার্নালে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল বা থিসিস পেপার প্রকাশনা করেছেন। তিনি মূলত অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা এডিট করে তা প্রকাশ করেছেন বলে র্যাবকে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।’
ইশরাত রফিক ঈশিতার বরাত দিয়ে র্যাব আরও জানায়, তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিদেশে প্রাপ্ত ভুয়া সাফল্য ও স্বীকৃতির প্রচারণা করতেন। ২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডব্লিউ-২০২০) পেয়েছেন। যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে ‘বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী’র পুরস্কার।
এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড-২০২০’; থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি তিনি পেয়েছেন। যা বাংলাদেশের প্রথম সারির গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয় বলে জানায় র্যাব।
করোনা নিয়েও ব্যবসা!
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ঈশিতা করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। তিনি এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে ৬০ জন চিকিৎসককে সার্টিফিকেট প্রদান করেন। যা ভুয়া সার্টিফিকেট। তিনি অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট গ্রহণে আকৃষ্ট করতেন। অন্তত ২০টি দেশে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন। এবং এজন্য ওই সব দেশে তিনি টাকার বিনিময়ে লোক রাখতেন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ঈশিতা প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানিতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশগ্রহণ করেন। এটা প্রমাণও আমরা পেয়েছি। পরবর্তীতে তিনি প্রচারণা করেন যে, তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এ ছাড়া তিনি আমেরিকান সেক্সসুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিক্যাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুডউইল-তে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর (দূত) হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি অ্যাওয়ার্ডবিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এডিটিং করা ভুয়া ছবি ও সনদ তৈরি করে গণমাধ্যমে প্রেরণ ও ভার্চুয়াল জগতে প্রচারণা করতেন। তিনি এসব করতেন মূলত বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা ও অবৈধ পথে অর্থ আয়ের জন্য।