বেনাপোল বন্দরে তীব্র পণ্যজট, খালাসের অপেক্ষায় কয়েকশ ভারতীয় ট্রাক
দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল। প্রতি বছর দেশের সিংহভাগ শিল্প কলকারখানা ও পোশাকশিল্পের মালামালের পাশাপাশি রাসায়নিক, মোটর পার্টস, গাড়ির চ্যাসিসসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি হয়ে থাকে এ বন্দর দিয়ে। বছরে এ বন্দর দিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার মালামাল আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি হয়ে থাকে। সরকারের কোষাগারে জমা হয় প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।
বেনাপোল বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় জায়গা সংকটে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র পণ্যজট। এতে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরে দীর্ঘদিনের এ সমস্যার কোনো সমাধান না হওয়ায় ক্ষোভ বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের। বন্দরের দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যে আগ্রহ কমার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় দিন দিন কমে আসছে বলে জানালেন কর্মকর্তারা। তবে শিগগিরই এ সংকটের সমাধান হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বেনাপোল দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় দেশের স্থল ও রেলপথে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয় ভারত থেকে। গত দুই বছর করোনা মহামারির ধকলের পর এ বছর আমদানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু বন্দরের গুদামে জায়গা সংকটের কারণে চাহিদামতো ট্রাক ঢুকতে না পারায় ব্যাহত হচ্ছে কার্যক্রম। রপ্তানি-আমদানি গেট থেকে বন্দরের গুদাম পর্যন্ত গাড়ি আটকে থাকছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে ভারতীয় ট্রাক প্রবেশ করছে ঢিলেঢালাভাবে।
দীর্ঘদিন ধরে বেনাপোল বন্দরে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা না থাকার ফলে ভারতীয় অংশে প্রতিদিন প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার ট্রাক মালামাল বোঝাই অবস্থায় এক মাসেরও বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকে। ওই ট্রাকের মধ্যে দৈনিক ছয় থেকে সাতশ ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করার কথা থাকলেও সেখানে দৈনিক মাত্র ২৫০-৩০০ ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। বাকি ট্রাক আসতে না পারায় আমদানিকারকদের প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ভারতীয় টাকা গচ্চা দিতে হয়। বর্তমানেও চার বা পাঁচ হাজার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় পার্কিংয়ের জায়গায়।
বেনাপোল বন্দরে পণ্য রাখার গুদামে জায়গা না থাকায় ভারত থেকে আসা পণ্য আনলোডের অপেক্ষায় ৮-১০ দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ভারতীয় ট্রাক চালকদের। যে কারণে ভারতের ব্যবসায়ীদের মাঝে পেট্রাপোল-বেনাপোল বন্দরে জায়গা সংকট ও অবকাঠামো নিয়ে চরম অসন্তোষ রয়েছে।
জানা গেছে, বেনাপোল বন্দরের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকার ১৭৫ একর জমি (নতুন শেড, কন্টিনার টার্মিনাল, হেভি স্টক ইয়ার্ড নির্মাণে জন্য) অধিগ্রহণের বিষয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পরবর্তীতে প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সবুজ পাতাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি হয়নি। বেনাপোল বন্দরে দ্রুত ভিত্তিতে ১৭৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হলে এ বন্দর থেকে কাস্টমসের প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকা ও বন্দরের ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব।
বেনাপোল বন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, এই স্থলবন্দরের ৩৪টি গুদাম ও ৮টি ইয়ার্ড, দুটি ট্রাক টার্মিনাল ও একটি রপ্তানি টার্মিনাল রয়েছে। কোথাও জায়গা খালি নেই। তীব্র পণ্যজট চলছে। বর্তমানে বেনাপোল বন্দরের গুদামের ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পণ্য আমদানি হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দরে যে শেডগুলো আছে সেখানে মালামাল রাখার ধারণ ক্ষমতা বাস্তবে ৫৯ হাজার মেট্রিক টন কিন্তু বর্তমানে দুই লাখ মেট্রিক টন মালামাল হ্যান্ডলিং হয়। যে কারণে, ভারত থেকে যে ট্রাকগুলো আসে তা বন্দরে ৮ থেকে ১০ দিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বেনাপোল স্থলবন্দরে ১৭৫ একর জমি অধিগ্রহণপূর্বক সেখানে কমপক্ষে ৩০টি নতুন শেড, হেভি স্টক ইয়ার্ড, কোল্ড স্টোর নির্মাণ জরুরি। এখনই বন্দর সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘আট থেকে দশ দিন পর্যন্ত ভারতীয় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। বন্দরের জায়গার মারাত্মক সংকট থাকার কারণে গাড়িগুলোকে অলস দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ও রাজস্ব বৃদ্ধির স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে বেনাপোল স্থলবন্দরের জায়গা সংকটসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন করার জন্য একাধিকবার নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেও কোনো আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি।’
মফিজুর রহমান সজন আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে বেনাপোল বন্দরে ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ায় (সাইড ডোর) এবং কনটেইনারের মাধ্যমে মালামাল আসছে, যা হেডলোডে বন্দরে আনলোড হচ্ছে। এ ছাড়া কমলাপুরের মতো কনটেইনার অপারেশন খুব শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে। সুতরাং জায়গা অধিগ্রহণসহ অবকাঠামোগত দিকগুলো উন্নয়ন করা দরকার।’
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপপরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, ‘অন্য সময়ের তুলনায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি কয়েকগুণ বেড়েছে। স্থলবন্দরে পণ্যের ধারণক্ষমতা ৫৯ হাজার টন। কিন্তু সেখানে দ্বিগুণের বেশি পণ্য রাখা হচ্ছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার গতি ফেরায় আমদানি-রপ্তানিও বেড়েছে। রেলপথেও প্রচুর পণ্য আসছে। এ কারণে পণ্য রাখার স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এতে বন্দরে শেড-ইয়ার্ড সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে জায়গা অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জায়গা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অধিগ্রহণকৃত জায়গায় শিগগিরই ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হলে বন্দরের পণ্যজটের সংকট অনেকটা কেটে যাবে।’
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে কিন্তু সে অনুপাতে রাজস্বের উৎস বাড়ছে না। এতে প্রতি বছরই দেখা দিচ্ছে রাজস্ব ঘাটতি। বন্দরের জায়গা বৃদ্ধির জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।’