ব্যবসায় মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে দুর্ভিক্ষের অবস্থা হতে পারে : জি এম কাদের
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেছেন, করোনার কারণে লকডাউন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে মাননীয় মন্ত্রীসহ দায়িত্বপ্রাপ্তরা দুর্নীতির বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। চার টাকার মাস্ক ৩৫০ টাকায় কেনা হচ্ছে। এগুলো সত্য হলে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
জি এম কাদের আরও বলেন, যতই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হোক, সুশাসন না থাকলে দুর্নীতি, অপচয় ও সমন্বয়হীনতার কারণে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সুশাসন না থাকলে যাদের উদ্দেশে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তারা লাভ করেন না। এক কথায় সুশাসন ছাড়া বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ অর্থহীন।
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কোভিড–১৯–এর টিকা প্রয়োগের কথা বলা হলেও আমদানির জন্য এই খাতে আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দের উল্লেখ নেই। টিকা সংগ্রহ এখন পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত বলা যায় না। ফলে, টিকা দেওয়ার কাজ পুনরায় শুরু ও শেষ কীভাবে ও কবে হবে, কেউ জানে বলে মনে হয় না।
জি এম কাদের আরও বলেন, মহামারির কারণে জীবিকা হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। তাদের মধ্যে যারা হতদরিদ্র, তাদের না খেয়ে থাকার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জীবিকা হারিয়ে নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ মানুষ। প্রতিদিন এর সংখ্যা বাড়ছে। করোনার কারণে লকডাউন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। সামাজিক সুরক্ষা খাত থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে ৪৬ শতাংশ সরকারি কোনো সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত নয়। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক প্রাপক অনিয়মের মাধ্যমে প্রকৃত প্রাপককে বঞ্চিত করে এ সুবিধা ভোগ করছে।
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দেশীয় ব্যাংকগুলো বেশির ভাগ রুগ্ণ। এগুলোর ওপর নির্ভরশীল হওয়া কতটা বাস্তবসম্মত? তা ছাড়া এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ার শামিল। এ বিষয় নিশ্চিতভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। যে কারণে এ সুযোগ রাখা হয়েছে বলা হয়, সেটা হলো দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করা। বেশ কয়েকটি বাজেটে কিছুদিন থেকে এ সুযোগ দেওয়া হয়ে আসছে। ফলাফল শূন্য।
জি এম কাদের বলেন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গত পাঁচ বছরে এক হাজার ২৪টি অর্থ পাচার ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। বিএফআইইউ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তথ্য–প্রমাণসহ প্রতিবেদন পাঠিয়েছ। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন কোনো তথ্য নেই। ২০১৯ সাল পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির মতে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হল-মার্কের চার হাজার কোটি টাকা অর্থ লোপাট, বিসমিল্লাহ গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম এবং বেসিক ব্যাংকের অনাদায়ি খেলাপি ঋণ উদ্ধারের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়।
জি এম কাদের আরও বলেন, ২০১৮-২১, এই স্বল্প সময়ে ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান কম্প্রোট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। তাদের তথ্যমতে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া আর্থিক অনিয়মের ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকিং খাতের, যার পরিমাণ ৩১ হাজার কোটি টাকা।
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, খেলাপি ঋণ না দেখিয়ে তা মুছে ফেলার সক্রিয় প্রয়াস চলছে। খেলাপি ঋণ বাড়লেও অনিয়মের মাধ্যমে সেটা লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৪০ শতাংশই হচ্ছে খেলাপি ঋণ। বিগত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খারাপের দিকে গেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিগত সময়ে আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দায়ীদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কর না বাড়ানো, সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়স বৃদ্ধি, ওষুধের মূল্য নির্ধারণে জাতীয় ওষুধনীতির প্রয়োগ করার দাবি জানান।