ভোলার তেঁতুলিয়া-মেঘনায় নিষিদ্ধ জালে চলছে জাটকা নিধন
দ্বীপ জেলা ভোলা। এর চারপাশেই মেঘনা আর তেঁতুলিয়া নদী। এ দুটি নদীতে অন্তত তিন শতাধিক খুঁটি, খুরচি, পিটানোসহ নিষিদ্ধ হাজার হাজার কারেন্ট জাল দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে মৎস্য সম্পদ। নিষিদ্ধ এসব জাল দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ প্রভাবশালীরা নদী দখল করে মাছ ধরছে। সাধারণ জেলেরা এসব এলাকায় মাছ শিকারে যেতে পারে না।
ভোলায় অন্তত আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ ধরা পড়লেই মেঘনাতীরের মাছের আড়তগুলো আর জেলেপল্লীতে দেখা যায় উৎসবের আমেজ। তবে দীর্ঘদিন ধরে নদীতে মাছ না পাওয়ায় জেলেদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল। সম্প্রতি নদীতে জেলেদের জালে ভালোই মাছ ধরা পড়ছে। তাই প্রাণ ফিরে পেয়েছে মাছের আড়তগুলোসহ জেলেপল্লী। তবে জেলেদের জালে ধরা পড়া প্রায় সবই জাটকা। এর অন্যতম কারণ, নদীতে সব নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল।
এসব বিষয়ে সাধারণ জেলে ও আড়তদারদের সঙ্গে আলোচনায় বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের আত্মীয়স্বজনরা মিলে মেঘনার লোভনীয় স্থানগুলো দখলে নিয়ে সেখানে শুধুই তাদের জেলেদের দিয়ে মাছ ধরান। ওই সব এলাকায় সাধারণ জেলেরা কখনোই ইলিশ বা কোনো মাছ ধরতে জাল ফেলতে পারে না।
মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্টে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ শিকাররত অবস্থায় জেলেদের সঙ্গে আলাপে বেরিয়ে আসে নানা তথ্য।
দূর থেকে দেখা যায়, কিছু মানুষ নদীর মাঝখানে ভাসছে। কাছে গেলে দেখা যায়, ফ্লুটের সঙ্গে পাতিল বেঁধে রেখেছে। তিন-চার কিলোমিটার বা তারও বেশি এলাকাজুড়ে ডুবো চরে একাধিক জাল ফেলে জেলেরা বড় বড় বাঁশ দিয়ে ওই জালের ভেতরের এলাকার পানিতে পেটাতে পেটাতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবে পিটিয়ে ধরা হয় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। ছোট-বড় যা থাকে সবই আটকে যায় জালে। এর মধ্যে বেশির ভাগই জাটকা। জাল থেকে ছুটিয়ে কোমড়ে বেঁধে রাখা রশিতে দ্রুত মালার মতো গেঁথে ফেলা হয় জাটকাসহ ইলিশ মাছ।
জেলেরা জানান, ভালো হলে একেকটি খ্যাওয়ে (প্রতিবার) দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মাছ পাওয়া যায়। পিটিয়ে নিষিদ্ধ পদ্ধতি আর নিষিদ্ধ কারেন্ট জালে মাছ ধরা অবস্থায় কথা হয় ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার মলংচরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরনবী বাবুলের জেলেদের সঙ্গে। তারা বলেন, আমরা সবাই চেয়ারম্যানের লোক। তার সাবার (জাল) দিয়েই মাছ ধরছি। এই স্থানে অন্যরা মাছ ধরতে পারে না। আমরাই ধরি। জেলেরা জানান, এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন তজুমদ্দিন উপজেলার মলংচরা ইউনিয়নের অধ্যক্ষ নুরনবী বাবুল চেয়ারম্যান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাসান নগর ইউনিয়নের মানিক হাওলাদারসহ চারজন। তারা হাকিমুদ্দিন সংলগ্ন মেঘনার ডুবোচরগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন।
এ বিষয়ে কথা হয় দৌলতখানের খুঁটিজাল, পিটানোসহ নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের মালিকদের সঙ্গেও। এ সময় মুঠোফোনে দৌলতখানের আব্দুল হাই বলেন, ‘ভোলা জেলায় অন্তত তিন থেকে চার শতাধিক জাল আছে। যার মধ্যে পিটানো জালই আছে দুই শতাধিক।’
নিজের একটা জাল আছে স্বীকার করে আব্দুল হাই আরও বলেন, ‘এসব জাল মেঘনার বিভিন্ন ডুবোচরে ফেলে ইলিশ মাছ ধরা হয়।’
এ সময় তিনি জেলায় যাদের নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল আছে এবং কারা কোন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে-তাও বলেন।
দৌলতখানের খুঁটিজালের মালিক মনু মাঝি বলেন, ‘আমরা চারজনে মিলে একটা সাবার (জাল) করেছি। ১১টা সাবার আছে বাকিদের। মাঝেমধ্যে অনেক মাছ পাওয়া যায়। বাবুল চেয়ারম্যান, মিজান মেম্বার, লিটন, মান্নান মাঝি, আব্দুল হাই, মনু, হাসান, কালামসহ আরও অনেকেরই আছে এসব জাল।’
দৌলতখানের হাজীপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. মিজান বলেন, ‘আমার একটা পিটানো জাল আছে। এ ছাড়া কবির, টিপু, সুমন, রিপন, মনির, সেলিম, কাজল মাস্টার, সাইফুল মেম্বারসহ আরও অনেকেরই এসব জাল আছে। তবে যেসব ডুবোচরে এসব জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়, তার সিরিয়াল (নিয়ন্ত্রণ) আমি করতাম। এখন টিপু করছে। দৌলতখানের হাজীপুরের মেঘনা এখন কবির ভাই নিয়ন্ত্রণ করছেন।’
এসব বিষয় শুধু মৎস্য অধিদপ্তর নয়, দেখার দায়িত্ব নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের থাকলেও তারা অদৃশ্য কারণে চুপ থাকছে।
সাধারণ জেলেরা অভিযোগ করে বলেন, সবাইকে ম্যানেজ করে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে মেঘনা নদী দখলে নিয়ে মাছ শিকার করছে প্রভাবশালীরা। তারা নিয়মিত মাসোহার দিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে সাধারণ জেলেদের আটক করা হলেও প্রভাবশালীরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব জেলে।
এ বিষয়ে ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম আজহারুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমরা বেশকিছু খুঁটিজালের খুঁটি কেটে দিয়েছি। এর মাধ্যমে নদীর বিশাল একটি অংশ দখল করে স্থায়ী ভাবে জাল পেতে মাছ ধরা হয়। পিটানো, খুঁটিজাল, খুরচিজালসহ সব ধরনের নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হবে। এ সব জালের মালিকদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।